‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে..

‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে কান্দে হাসন রাজার মনমুনিয়া রে’ আবার ‘লোকে বলে বলেরে ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার- কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার’, আবার ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নাম না কইলাম তার কাম- বৃথা কাজে হাসন রাজায় দিন গুজাইলাম’ আবার ‘সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইলো সোনা বন্ধে আমারে পাগল করিল- আরে না জানি কি মন্ত্র করি জাদু করিল’ এই গানগুলোই হাসন রাজাকে চিনিয়ে দেয় আমাদের। সুনামগঞ্জের মরমি গীতিকার বিত্তশালী পরিবারের সন্তান ছিলেন। যৌবন ছিল মৌজ-ফুর্তিতে ভরপুর। বিলাসবহুল সৌখিন জীবনে অভ্যস্ত হাসন আসক্ত ছিলেন নারীসঙ্গে। অবশ্য পরিনত বয়সে পৌঁছে আমূল বদলে গেলেন হাসন। তা এতটাই মানুষের মনের ঘৃণার স্থলটি জয় করে নিলেন ভালবাসায়।
হাসন রাজা ১৬১তম জন্মদিন আজ। মরমী কবিকে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। ডিসেম্বরেই জনম তার, ডিসেম্বরেই মরণ। তার প্রকৃত নাম দেওয়ান হাসন রাজা। যে নামটি তার চাপা পড়ে আছে, সেটি হচ্ছে অহিদুর রেজা। দেওয়ান হাসন রাজার জন্ম ২১ ডিসেম্বর, ১৮৫৪। মৃত্যু ৬ ডিসেম্বর, ১৯২২। আর বাংলা সনের হিসাবে জন্ম ৭ পৌষ, ১২৬১। মৃত্যু ২২ অগ্রহায়ণ, ১৩২৯। সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে তেঘরিয়া গ্রামেই জন্ম।

হাসন রাজা একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী। বাংলার দর্শনচেতনার সঙ্গে সঙ্গীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে এই মরমী সাধনা। অনেকেই মনে করেন লালন শাহ্ এই মরমী সাধনার প্রধান পথিকৃৎ। আর লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার।

হাসন রাজা জমিদার পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তার দ্বিতীয় পুত্র। মায়ের নাম হুরমত জাহান। যিনি ছিলেন নিঃসন্তান বিধবা। তার আগের স্বামী মারা যাওয়ার পর আলী রাজা চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয়। এখানেই জন্ম হাসন রাজার। এ সময় তার নামকরণ হয়েছিল অহিদুর রাজা। পরে সিলেটে ডেপুটি কমিশনার অফিসের এক ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শে তার নাম হয়ে যায় হাসন রাজা। বহু দলিল দস্তাবেজে হাসন রাজা আরবি অক্ষরে নাম দস্তখত করেছেন হাসন রাজা।

হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন। বহু লোকের মধ্যে চোখে পড়ার মতো। উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় চোখ এবং একমাথা কবিচুল। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তবে স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেন।

পরে সিলেটে ডেপুটি কমিশনার অফিসের এক ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শে তার নাম হয়ে যায় হাসন রাজা। বহু দলিল দস্তাবেজে হাসন রাজা আরবি অক্ষরে নাম দস্তখত করেছেন হাসান রাজা। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন। বহু লোকের মধ্যে চোখে পড়ার মতো। উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় চোখ এবং একমাথা কবিচুল।

অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তবে স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেন।

উত্তারিধাকার সূত্রে হাসন রাজা ছিলেন বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক। হাসন রাজা তার গানে ভোগ-বিলাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বললেও নিজে ভোগ-বিলাসেই মত্ত থেকেছেন। প্রতিবছরই বর্ষাকালে নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ তিনি নৌকায় চলে যেতেন এবং ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত রাখতেন। এর মধ্যেই বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন, নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত।

হাসন রাজা পাখি ভালোবাসতেন। তিনি ঘোড়া পুষতেন। সৌখিনতার পিছনেই তার সময় কাটতো। আনন্দ বিহারে সময় কাটানোই হয়ে উঠলো তার জীবনের একমাত্র বাসনা। তিনি প্রজাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। অত্যাচারী আর নিষ্ঠুর রাজা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠলেন। হাসন রাজা দাপটের সঙ্গে জমিদারী চালাতে লাগলেন।

হঠাৎ করেই আধ্যাত্মিকতায় পেয়ে বসে হাসন রাজাকে। আমূল বদলে যান হাসন রাজা। বদলে যায় তার জীবন দর্শন। বিলাস প্রিয় জীবন তিনি ছেড়ে দিলেন। নিজের ভুল ত্রুটি শুধরাতে শুরু করলেন। রাজসিক পোশাক-আশাক ছেড়ে দিলেন। শুধু বর্হিজগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা। বৈরাগ্য। সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নেয়া হয়ে উঠলো তার প্রতিদিনের কাজ। আর সকল কাজের উপর ছিল গান রচনা। তিনি আল্লাহ্র প্রেমে মগ্ন হলেন। তার সকল ধ্যান ধারণা গান হয়ে প্রকাশ পেতে লাগলো।

আধ্যাত্মিকতায় তিনি পুরোদস্তুরই নিমজ্জিত হলেন। জীব-হত্যা ছেড়ে দিলেন। কেবল মানব সেবা নয়, জীব সেবাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। এই হাসন যেন আগের হাসনের পুরোপুরিই বিপরীত।

‘গুড্ডি উড়াইল মোরে, মৌলার হাতের ডুরি/ হাসন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি/ মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা/ যেমনে ফিরায়, তেমনি ফিরি, এমনি ডুরির ফান্ধা।’ কিংবা ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে/ আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে।’ কিংবা ‘স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল/ কেমনে করিবে হাসন বন্ধের সনে মিল।’ কিংবা ‘আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে/ হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।’ আবার ‘ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন/ সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন।’

পরিণত বয়সে তিনি বিষয় সম্পত্তি বিলিবন্টন করে দরবেশ-জীবন যাপন করেন। হাসন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। গানের জন্যই তিনি ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন। তিনি কতো গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। `হাছন উদাস` গ্রন্থে তার ২০৬ টি গান সংকলিত হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু গান `হাসন রাজার তিনপুরুষ` এবং `আল ইসলাহ্` সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

শোনা যায়, হাসন রাজার উত্তরপুরুষের কাছে তার গানের পান্ডুলিপি আছে। অনুমান করা চলে, তার অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে, কালের নিয়মে বেশ কিছু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাসনের অপর গ্রন্থ `সৌখিন বাহার`। `হাছন বাহার` নামে তার আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাসন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়।

হাসন রাজা মুখে মুখে গান রচনা করতেন, আর তার সহচরবৃন্দ কী নায়েব-গোমস্তা সে সব লিখে রাখতেন। তার স্বভাবকবিত্বে এসব গানে জন্ম নিত। হাসন রাজার গানে অনেক উজ্জ্বল পংক্তি, মনোহর উপমা-চিত্রকল্পের সাক্ষাৎ মেলে। তার কিছু গান, বিশেষ করে `লোকে বলে, বলেরে, ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার`, `মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে`, `আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপরে`, `সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল`, `মরণ কথা স্মরণ হইল না হাসন রাজা তোর`, `আমি যাইমুরে যাইমু আল্লার সঙ্গে`, `কানাই তুমি খেইর খেলাও কেনে`, `একদিন তোর হইব রে মরন রে হাসন রাজা`- সমাদৃত ও লোকপ্রিয় শুধু নয়, সঙ্গীত-সাহিত্যের মর্যাদাও লাভ করেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ ওহফরধহ চযরষড়ংড়ঢ়যরপধষ ঈড়হমৎবংং-এর প্রথম অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতির অভিভাষণে তিনি প্রসঙ্গক্রমে হাসন রাজার দুটি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তাঁর দর্শন চিন্তার পরিচয় দেন। ভাষণটি `গড়ফবৎহ জবারব`ি ( ঔধহঁধৎু ১৯২৬ ) পত্রিকায় `ঞযব ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ ঙঁৎ চবড়ঢ়ষব` শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এর অনুবাদ প্রকাশিত হয় `প্রবাসী` ( মাঘ ১৩২২ ) পত্রিকায়।

১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে `হিবার্ট লেকচারে` রবীন্দ্রনাথ `ঞযব জবষরমরড়হ ড়ভ গধহ` নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাসন রাজার দর্শন ও সঙ্গীতের উল্লেখ করেন।

হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণ : হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সিলেট নগরীর প্রানকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে একটি যাদুঘর। এর নাম দেওয়া হয়েছে মিউজিয়াম অব রাজাস’। এখানে দেশ বিদেশের দর্শনার্থীরা হাছন রাজা ও তার পরিবার সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে প্রতিদিন ভিড় করছেন।

মিউজিয়ামে দেওয়ান হাছন রাজার মূল্যবান ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও গানের পান্ডুলিপি শোভা পাচ্ছে। প্রবেশদ্বারে রয়েছে হাসন রাজার বাড়ির ধ্বংসাবশেষের একটি পিলার। মিউজিয়ামটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে-পবিত্র কোরআন শরীফের ছোট আকারের একটি কপি। কোরআন শরীফটির সাইজ হচ্ছে-পৌণে এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি। এখানে শোভা পাচ্ছে হাসন রাজার ঘোড়ার বেল্ট, তার জন্মস্থান ও জমিদারী এলাকা থেকে সংগৃহীত ইট, রাজার পোষা কুড়া পাখি ও হাতির নামের তালিকা, তার ব্যবহৃত শ্বেত পাথর ও রুপার তৈজস পত্র, হাসন রাজার ওপর নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়া ছবিতে ব্যবহৃত পোষাক ও ছবির সিডি, তার স্ত্রীর ব্যবহার্য জিনিসপত্র, দেওয়ান একলিমুর রাজার ব্যবহৃত চেয়ার, তার স্ত্রীর ব্যবহার্য সোনার তারের ও রুপার তারের তৈরি পোশাক, তার ব্যবহৃত হিসাবের খাতা, বৃটিশ সরকার প্রদত্ত খান বাহাদুর মেডেল এবং দেওয়ান রাজা সংগৃহিত হাসন রাজার গানের পান্ডুলিপি।

পুত্র : খান বাহাদুর দেওয়ান গণিউর রাজা চৌধুরী (১২৮৩-১৩৩৯ বাংলা), দেওয়ান হাসিনুর রাজা চৌধুরী (১২৮৫-১৩৫১ বাংলা), খান বাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী (১২৯৬-১৩৭১ বাংলা) দেওয়ান আফতাবুর রাজা চৌধুরী (১৩০৩-১৩৬২ বাংলা)। কন্যা : রওশন হুসেইন বানু, রওসন হাসান বানু, আলী হুসেইন বানু, রওশন আখতার বানু।

হাসন রাজা মিউজিয়াম : সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়ায় এলাকায় সুরমা নদীর কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে হাসন রাজার স্মৃতি বিজড়িত বাড়ীটি। এ বাড়িটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কালোত্তীর্ণ এ সাধকের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতার ও গানের পান্ডুলিপি আজও বহু দর্শনার্থীদের আবেগ আপ্লুত করে।

সুনামগঞ্জ পৌর এলাকায় গাজীর দরগা নামক পারিবারিক কবরস্থানে প্রিয়তম মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন মরমী কবি হাসন রাজা। যে কবরখানা মৃত্যুর পুর্বেই নিজে প্রস্তুত করেন। হাসন রাজার মাজার দেখার জন্য প্রতি বৎসর বহু দর্শনার্থীর সমাগম হয়।



মন্তব্য চালু নেই