মানুষের খুলি দিয়ে তৈরি টাওয়ার!

দেয়ালে দেয়ালে মানুষের খুলি লাগানো। দেখলে বোঝা যায় মানুষের খুলি দিয়ে তৈরি দালান।

এটা কোনো ভুতুড়ে গল্প নয়। কোনো কাল্পনিক কল্পকাহিনীও নয়। একটি সত্য ঘটনা। মানুষের ক্ষমতার নির্মম ব্যবহারের নিদর্শন হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে সার্বিয়ার ‘স্কাল টাওয়ার’ বা খুলির তৈরি দালান।

১৮০৯ সাল। সার্বিয়া তখন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। সার্বিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব দিকের শহর ‘নিস’ এর দায়িত্বে ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের উজির তুর্কিশ জেনারেল হার্সি পাশা।

হঠাৎ নিস শহরের কিছু সচেতন ও দেশপ্রেমী মানুষ তাদের স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হতে লাগল। আস্তে আস্তে তা আন্দোলনে রূপ নিল। শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলল তারা।

প্রতিরোধ সৃষ্টিকারীরা সংখ্যায় ছিল হাজার খানেক। তাদের দমন করতে অস্ত্র-শস্ত্র সজ্জিত ৩৬ হাজার সৈন্য নিয়ে হাজির হলেন হার্সি পাশা। এতো সৈন্য-সামন্ত দেখে বিদ্রোহীদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক ভয়ে পিছু হটে। বাকি যারা ছিল তারা পালিয়ে যাওয়া কিংবা আত্মসমর্পণ না করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তারা নিসের সিজার পাহাড়ে অবস্থান নিল। সীমিত সামর্থ ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগল।

কিন্তু হার্সি পাশার অস্ত্র-শস্ত্র সজ্জিত সৈন্যদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তারা পেরে উঠল না। বিদ্রোহীদের প্রধান স্টিভান সিনডেলিককে গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। তার সমর্থকদের মস্তক শরীর থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। যুদ্ধে যে অটোমানদের জয় হয়েছে সেটার প্রমাণ হিসেবে বিদ্রোহীদের দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইস্তাম্বুলে সুলতানের কাছে।

আর গভীর ক্ষোভ থেকে তার উজির হার্সি পাশা সিদ্ধান্ত নেন বিদ্রোহীদের খুলি দিয়ে তিনি নিস শহরের প্রবেশ পথে টাওয়ার তৈরি করবেন। যা দেখে যাতে কেউ দুঃস্বপ্নেও অটোমানদের বিরোধীতা করার সাহস না পায়।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। বিদ্রোহীদের ৯৫২টি মাথার খুলি দিয়ে তিনি তৈরি করলেন একটি টাওয়ার। যেটার উচ্চতা ছিল ১৫ ফুট। আর লম্বায় ছিল ১৩ ফুট। টাওয়ারের দেয়ালে খুলিগুলোকে ৫৬ সাড়িতে সাজানো হয়। টাওয়ারের প্রত্যেক পাশের সাড়িতে ১৭টি করে খুলি দেওয়া হয়। সেখানে বিদ্রোহীদের নেতৃত্বদানকারী স্টিভান সিনডেলিকের খুলিটি দেওয়া হয় সবার ওপরে।

সেই নির্মমতার সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে স্কাল টাওয়ার। তবে হার্সি পাশা যে উদ্দেশ্যে এই খুলির টাওয়ার তৈরি করেছিলেন সেটা সফল হয়নি। ১৮১৫ সালে আবারো সার্বিয়ানরা বিদ্রোহ করেন। এবার তারা সফল হন। আর ১৮৩০ সালে তারা স্বাধীনতা লাভ করেন।

স্বাধীনতা লাভ করার পর পরই বিদ্রোহীদের পরিবার টাওয়ারের দেয়াল থেকে স্বজনদের খুলি নিয়ে যায় তাদের যথাযথ অন্তষ্টিক্রীয়ার জন্য। এখনো টাওয়ারটিতে ৫৮টি খুলি রয়েছে।

১৮৯২ সালে সার্বিয়া কর্তৃপক্ষ এই টাওয়ারকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। যাতে সার্বিয়ার মানুষ তাদের বীর সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে পারে।

টাওয়ারের চারপাশে ভজনালয় তৈরি করে কর্তৃপক্ষ। এটাকে স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যেটা সার্বিয়ার মানুষের সাহসিকতা ও ভোগান্তির নিদর্শন হিসেবে ২০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বিদ্রোহীদের প্রধান স্টিভান সিনডেলিকের খুলিটি আলাদাভাবে প্রদর্শনের জন্য সেখানে রাখা আছে।

যে টাওয়ারটি এক সময় মানুষকে ভয়ভীতি দেখানো ও বিদ্রোহ থেকে বিরত রাখতে তৈরি করা হয়েছিল- সেটাই এখন পরিণত হয়েছে মানুষের ভ্রমণের গন্তব্যে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সার্বিয়ার নিস শহরে আসেন এই খুলির তৈরি টাওয়ার দেখতে।

অবশ্য তারা এখানে এসে তুর্কিশ জেনারেল হার্সি পাশার মতো ক্ষোভ ও রাগ ঝারেন না। তারা বিদ্রোহীদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। শান্তি কামনা করেন গোটা বিশ্ব ও মানবজাতির।



মন্তব্য চালু নেই