মা ছাড়া প্রথম ঈদ মাহির-টাপুরের

পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহবুবা আক্তার মিতু খুন হয়েছেন- এ খবরে সারাদেশে তোলপাড় হয়ে গেলেও, এই দম্পতির ফুটফুটে দুই ছেলে-মেয়েকে প্রথমে জানানো হয়নি তাদের মা আর কখনো ফিরবে না। ভাই-বোনের মধ্যে মাহির অবশ্য নিজের চোখে দেখেছে, তার মায়ের উপর হামলার দৃশ্য, খুনিদের পা ধরে কেঁদেছেও সে মাকে বাঁচাতে।

৫ জুন মাহিরকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পথেই খুন করা হয় মিতুকে। মাহিরের সামনেই হামলা চালানো হলেও সে আর জানতো না শেষ পর্যন্ত কী হলো মায়ের। পরবর্তী নানা ঘটনাপ্রবাহ, দীর্ঘ দিন নানার বাসায় অবস্থান, বাসায় পুলিশের টহল আর সবচেয়ে বড় কথা মায়ের অনুপস্থিতিতে ধীরে ধীরে মাহির ও তার বোন তাবাসসুম টাপুর বুঝতে পেরেছে তাদের মা আর নেই।

মিতু আক্তার খুন হওয়ার পর মাহির-টাপুরের এটাই হবে প্রথম ঈদ। মাকে হারানোর পর থেকে তারা আছে খিলগাঁওয়ে নানা মোশাররফ হোসেনের বাসায়। বাবা বাবুল আক্তার তাদের সঙ্গে থাকলেও হত্যকাণ্ড পরবর্তী নানা ঘটনায় তিনি যে বাড়তি চাপে আছেন তা স্পষ্ট।

সোমবার বিকেলে খিলগাঁওয়ে মাহির-টাপুরের নানা বাসায় গিয়ে দেখা যায়, টিভিতে কার্টুন দেখায় ব্যস্ত তারা। পাশেই ছিলেন খালা শায়লা মোশাররফ নিনজা। নিনজাকে ওরা মামনি বলে ডাকে। ইফতারের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন নানী শাহিদা মোশাররফ।

নানা চাপে আর স্ত্রী হারানোর বেদনায় জর্জরিত বাবুল আক্তার খুব একটা বের হন না। বাবুল প্রসঙ্গে নিনজা বলছিলেন, ‘ডিবি অফিসে তলব ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানামুখি সংবাদ মাধ্যমের তৎপরতা আর স্ত্রী বিয়োগের যন্ত্রণায় কাতর দুলাভাইল।’

বারান্দায় বসে কথা হচ্ছিল শাহিদা মোশাররফ ও নিনজার সঙ্গে। মাহির ও টাপুর কেমন আছে- জানতে চাইলে, নানী শাহিদা বলেন, ‘ওদের জন্য খুব কষ্ট হয়। ওরা বুঝে গেছে, ওদের মা আর বেঁচে নেই।’

হঠাৎ করেই মাহির কেঁদে ওঠে। বলে মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। টাপুর বলে ভালো লাগছে না। খালাকে বলে, চলো না কোথাও বেড়াতে যাই।

নিনজা বলেন, ওদের দেখাশোনার জন্য আমি আপাতত বাবার বাড়িতেই আছি। দুলাভাইই ওদের তিনবেলা নিজ হাতে খাইয়ে দেন। মা-হারা শিশু দুটি বাবার উপর বেশি নেতিয়ে পড়েছে। দুলাভাইও ওদের নিয়ে বেশিরভাগ সময় কাটান। বুকে পিঠে নিয়ে আদর করেন। ওদের মা হারানোর জ্বালাটা ভোলানোর চেষ্টা করেন।

ঈদ আসছে। ওরা কি ঈদে এখানেই থাকবে- জানতে চাইলে নিনজা বলেন, ‘ওরা বেশিরভাগ সময়ই বাবা-মায়ের সঙ্গে দাদার বাসায় ঈদ করেছে। গতবার অবশ্য ওদের ঈদ কেটেছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু এবার তো আপু নেই। মা-হারা বাচ্চা দুটাকে এবার আর ছাড়ছি না। ওরা এখানেই ঈদ করবে।’

কথা বলতে বলতে হঠাৎেই কেঁদে ওঠেন শাহিদা মোশাররফ। তিনি বলেন, ‘মিতু ওদের জন্য ঈদের আগেই কেনাকাটা সেরেছিল। কি পরিতাপ, মায়ের হাতে কেনা ঈদের পোশাক পাচ্ছে, ঈদে কিন্তু মাকে পাচ্ছে না।’

মেয়ে আগেও দু’বার বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। সে কথা স্মরণ করে শাহিদা বলেন, ‘মিতু দুই বার মরতে মরতে বেঁচে গেছে। একবার ম্যানহোলে পড়ে। আরেকবার বাস চাপা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। তাই ও সব সময় বলতো, মা আমার মরণ হবে না। কিন্তু সেই মিতুই কি না মানুষের হাতে খুন হলো। এখন বাচ্চা দুইটাকে কী অসহনীয় যন্ত্রণা আর মায়ের আদর ছাড়াই বড় হতে হবে।’

মেয়ে হারানোর তীব্র বেদনা নিয়ে আক্ষেপের সুরে প্রশ্ন রাখেন, ‘তুই (মিতু) মরলিই যদি সন্তান জন্মের আগেই মরলি না কেন?’

মাহির ও টাপুরের জন্য ঈদের জামাকাপড় কেনা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে নিনজা বলেণ, ‘ওদের জন্য কেনাকাটা করেছি। জামা কাপড়, প্যান্ট। জানেন ভাই, আপুর জন্যও এবারের ঈদে দুটি থ্রিপিস ও শাড়ি কিনেছিলাম। কিন্তু দেয়া গেল না। তার আগেই…’

বোন হারানোর কষ্টে আড়ষ্ট নিনজা। মিইয়ে যায় তার মুখের ভাষাও। মুখে হাত দিয়ে কেঁদে ওঠেন।

ঈদের দিন ওদের কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন? বলতেই নানী শাহিদা বলেন, ‘নাহ! বাইরে আর কোথায় নিয়ে যাবো বলেন। ওদের এলাকাতেই ঘোরাবো। পাশে মিতুর চাচা শহীদুল ইসলামের বাসায় নিয়ে যাব।’

নিনজা বলেন, ‘মেয়েটা বয়সে ছোট হলেও অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। ওরা আমাকে মামনি বলে ডাকে। টাপুর বলে, মামুনি ভালো লাগছে না কোথাও ঘুরতে যাবো। নিয়ে চলো। মা-বাবার সঙ্গে কতো জায়গায় না ওরা ঘুরেছে। কিন্তু এখন হচ্ছে না। তবে আরেকটু সময় করে ওদের ঘুরতে নিয়ে যাবো বিভিন্ন জায়গায়।

শাহিদা ও নিনজার সঙ্গে কথা কথা হতে হতেই নিচে নামে টাপুর। খালার কাছে এসে বলে, চলো না বাইরে যাই। একদম ভালো লাগছে না…ও তুমি কথা বলছো? বলো, কথা শেষে আমাকে বাইরে নিয়ে যাবে কিন্তু।

বাইরে নিয়ে যাওয়ার এ আবদার রেখে টিভির রিমোট নিয়ে ঘরে ঢুকে আবার কার্টুন দেখতে শুরু করে টাপুর।

গত ৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় চট্টগ্রামের জিইসি এলাকায় গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে এই মামলার আসামি ওয়াসিম, আনোয়ার, অস্ত্র সরবরাহকারী ভোলা ও তার সহযোগী মনিরকে গ্রেফতার করেছে।

তবে এরই মধ্যে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে জনমনে বেশ ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। তার কারণ মূলত, গত ২৪ জুন গভীর রাতে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারকে বাসা থেকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ।

মিতু হত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব, সিআইডি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিআই)। খবর: জাগো নিউজ



মন্তব্য চালু নেই