মিতু হত্যা : রহস্য আরো ডালপালা মেলল

আলোচিত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে অব্যাহতি দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। ৫ জুন স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের তিন মাসের মাথায় বাবুল আক্তারকে পুলিশ বাহিনী চাকরি থেকে অব্যাহতি দিলেও মিতু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখনো শেষ করতে পারেনি পুলিশ। আবার মিতু হত্যা মামলার বাদী বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রায় আড়াই মাস পর অব্যাহতি এবং মিতু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা মুছা সিকদার ‘রহস্যজনক’ নিখোঁজ থাকায় পুরো ঘটনা আরো রহস্যের সৃষ্টি করল।

গত ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরের জিইসির মোড় এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাত ও গুলিতে নিহত হন মাহমুদা খানম মিতু। ঘটনার পরদিন বাবুল আক্তার বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি এখন তদন্ত করছেন চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান।

হত্যাকাণ্ডের পর আবু নছর গুন্নু ও রবিন নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও এদের জবানবন্দি থেকে কিছুই মেলেনি। পরে ওয়াসিম ও আনোয়ার নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ দাবি করেছে এরা দুজনই ভাড়াটে খুনি। পুলিশ দাবি করে, এ দুজন জবানবন্দিতে খুনের সঙ্গে সাতজন জড়িত বলে জানিয়েছে। এর পর থেকে জবানবন্দি থেকে পাওয়া অন্যতম ‘খুনি’ মুছা সিকদার ‘রহস্যজনক’ভাবে নিখোঁজ হয়ে যান।

সন্দেহভাজন দুজন খুনি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায়। আর মামলার বাদী বাবুল আক্তারকে ২৪ জুন রাতে ঢাকার গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে টানা ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখানে পদত্যাগপত্রে বাবুলের সই নেওয়ার অভিযোগ, বাবুলের চাকরি ফিরে পাওয়ার আকুতি, স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন বলে আইজিপির দাবি—সব কিছুতেই ‘রহস্যের’ গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। সর্বশেষ গতকাল বাবুলকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।

বাবুল আক্তারকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশের ডিআইডি (মিডিয়া) এ কে এম শহিদুর রহমান। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে বাবুল আক্তার সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। সরকার সেই আবেদন মঞ্জুর করেছে। মঙ্গলবার বিকেলে সেই কপি পুলিশ সদর দপ্তরে পৌঁছেছে।’ স্ত্রী খুনের তিন মাসের মধ্যেই পুলিশ সুপার স্বামীকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হলো, অথবা তিনি কোন প্রেক্ষাপটে পদত্যাগ করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন কি না সেই বিষয়ে কিছুই স্পষ্ট করে বলেননি তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে এর বেশি কিছু জানি না।’

কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবরে স্ত্রী মিতু হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে বাবুল আক্তারের নাম প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান কিংবা পুলিশের শীর্ষ মহল এ ধরনের তথ্য নিশ্চিত করেনি। তদন্তকারী কর্মকর্তার ভাষায় অন্যতম ‘খুনি’ মুছা সিকদারকে পাওয়া গেলেই খুনের প্রকৃত সত্য জানা যাবে। যদিও মুছার স্ত্রী পান্না সিকদার দাবি করে আসছেন, তাঁর স্বামীকে ২২ জুন পুলিশ আটক করেছে। সেই থেকে মুছার হদিস মিলছে না। পুলিশ অবশ্য মুছাকে আটকের কথা স্বীকার করে না।

মুছার হদিস না মিললেও বাবুল আক্তারের চাকরি শেষ হয়ে গেছে। গণমাধ্যমে স্ত্রী খুনের নির্দেশদাতা হিসেবে বাবুল আক্তারের নাম প্রচারিত হওয়ার পর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবেগঘন লেখা লিখেছেন। এ নিয়েও হইচই হয়েছে।

যদিও তাঁর সহকর্মীদের অনেকেই দাবি তুলেছিলেন, খুনের দায় যদি বাবুল আক্তারের ওপর বর্তায়, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। আর খুনের দায় তাঁর ওপর না বর্তালে তাঁর চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। শেষ পর্যন্ত তাঁকে অব্যাহতিই দেওয়া হলো। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে চিহ্নিত হলো না মিতু হত্যার নির্দেশদাতার পরিচয়।

বাবুল আক্তারের সহকর্মীদের একজন নাম প্রকাশ হবে না শর্তে বলেন, ‘চাকরি থেকে বাবুল আক্তারকে অব্যাহতি দিয়ে পুলিশ বাহিনী পরোক্ষভাবে প্রমাণ করেছে বাবুলই খুনের নির্দেশদাতা। কিন্তু বাবুল যদি প্রকৃত নির্দেশদাতাই হন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার না করা কিংবা ক্ষমা করার অধিকার পুলিশকে কে দিল? দেশে আইন আছে। প্রচলিত আইনের আওতায় কেন তাঁকে নেওয়া হলো না?’ তিনি আরো বলেন, পুলিশ বাবুল আক্তারকে অব্যাহতি দিয়ে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তিই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এখন সারা দেশের মানুষ বলবে, নিজ বাহিনীর সদস্য বলেই খুনের দায় থেকে বাবুলকে অব্যাহতি দিয়েছে পুলিশ। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘পুরো বিষয়টিকে আরো বেশি রহস্যময় করে দেওয়া হলো।’

বাবুল আক্তার খুনের ‘নির্দেশদাতা’ কি না জানতে ফোন করা হয় নগর পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহারকে। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে একটু বিপদে আছি, পরে কথা বলি।’

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি তদন্তে এমন কিছু পাইনি। আমি ওনার (বাবুল আক্তারের) অব্যাহতির বিষয়ে কিছু জানিও না।’ মিতু হত্যা মামলার বাদী পরিবর্তন হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাদী পরিবর্তনের কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।’ বাবুল আক্তারকে গ্রেপ্তারের কোনো নির্দেশনাও নেই বলে তিনি জানান। মামলার অভিযোগপত্র কখন দাখিল হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত শেষ করতে এখনো অনেক কাজ বাকি। আমি মুছাকে খুঁজছি।’

এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে বাবুল আক্তারকে ফোন করা হলে তিনি অন্য প্রান্ত থেকে সাড়া দেননি। ফলে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।খবর দৈনিক কালের কণ্ঠের।



মন্তব্য চালু নেই