মিশন শেষে ওরা পালাতে চেয়েছিল, রেস্তোরাঁর বাইরেও সহযোগী ছিল

রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে হামলাকারীরা তাদের হত্যা মিশন শেষ করে সটকে পড়তে চেয়েছিল। গত শুক্রবার রাত সোয় ৮টায় ওই রেস্তোরাঁয় প্রবেশের পর পরই তারা নৃশংসভাবে গুলি ছুড়ে ও বোমা ফাটিয়ে হত্যাকাণ্ড শুরু করে। এরপর ভেতরে গিয়ে জিম্মি করে রাখাদের মধ্যে ২০ জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে। আর সেই সব ছবি তুলে তা মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপলোড করে। পরে আমাক নিউজ এজেন্সি ও সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ থেকে প্রকাশিত ওই সব ছবিতে টাটকা রক্তের ওপর পড়ে থাকা মৃতদেহ দেখা যায়। এভাবে তারা সাতটি ছবি আপলোড করে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাওয়ায় তাদের সটকে পড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।

এ ছাড়া ওই এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়াতে লাশের ছবি পাঠানোও বন্ধ হয়ে যায়। তবে রাত ১১টার আগেই তারা তাদের হত্যা মিশন সম্পন্ন করে। এরপর ওয়াকিটকির মাধ্যমে সে তথ্য তাদের সহযোগীদের জানিয়ে দেয়। ২০ জনকে হত্যা করার তথ্য সাইট ইন্টেলিজেন্সে প্রকাশ হলে রাত ২টার দিকেই বিবিসিতে এ সংবাদ চলে আসে। সন্ত্রাসবিরোধী অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি সূত্র ঘটনাস্থলে অবস্থান করে তাদের পর্যবেক্ষণ ও জিম্মি অবস্থা থেকে ছাড়া পাওয়াদের বরাত দিয়ে এসব তথ্য জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হামলার পর পরই গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা রেস্তোরাঁর খুব কাছেই সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেন। হামলার সময় সেখান থেকে পালাতে পারা রেস্তোরাঁকর্মীদের বর্ণনা এবং নিজেদের পর্যবেক্ষণে তাঁরা হামলাকারীদের কাছে কী কী ধরনের অস্ত্র আছে তা জেনে যান। তাঁদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, হত্যা মিশন সম্পন্ন করার পর সন্ত্রাসীরা পালানোর পথ পায়নি। সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে থান্ডারবোল্ট অপারেশনে নির্মূল হওয়ার আগে কয়েকবার তারা পালানোর চেষ্টা করে।

সকালে ক্লিনিকের দিকের দরজায় এসে সন্ত্রাসীদের একজন হাত উঁচিয়ে কিছু বার্তা দেওয়া বা নেওয়ার চেষ্টা করে। লেকের দিক (রেস্টুরেন্টের পূর্ব দিক) থেকেও তারা একই বার্তা দেওয়া বা নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে ধারণা পাওয়া যায়, বাইরে তাদের সহযোগীরা ছিল। এ ধারণা থেকে লেকের পূর্ব পাশেও অপারেশন চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু কাউকে পাওয়া যায়নি।

সূত্র জানায়, হত্যা মিশন শেষে সন্ত্রাসীরা বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলার পর বাকি সময়টুকু বসে থেকে, পায়চারি করে বা নিজেদের মধ্যে কথা বলে সময় পার করে। এ সময় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কয়েক সন্ত্রাসীকে ইচ্ছা করলেই গুলি করে মেরে ফলতে পারতেন। কিন্তু ভেতরের জীবিত জিম্মিদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাঁরা তা করেননি।

কী ধরনের অস্ত্র বহন করেছিল তারা : শনিবার দুপুরে ঢাকা সেনানিবাসে সেনা সদরের অফিসার্স মেসে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশন্স পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী জানান, ঘটনাস্থল থেকে প্রাথমিকভাবে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত পিস্তল, ফোল্ডেট বাঁট একে ২২ রাইফেল (সেমি অটো রাইফেল), অবিস্ফোরিত আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস), ওয়াকিটকি সেট ও ধারালো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র আরো অনেক অস্ত্র উদ্ধারের তথ্য জানায়। জানা যায়, এসব অস্ত্রের মধ্যে তিনটি একে-৪৭ রাইফেল, একে-৪৭ রাইফেলের গুলি ভরা পাঁচটি ম্যাগাজিন এবং পিস্তলের (বিআইএইচএআর) চারটি গুলি ভরা ম্যাগাজিনও ছিল। সন্ত্রাসীরা রেস্তোরাঁয় প্রবেশের সময় হ্যাভারসেক (পিঠে ঝোলানো ব্যাগ) বহন করছিল। প্রতিটি ব্যাগ ছিল আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক ভরা। হামলার দিন সকালে আমাক নিউজ এজেন্সি ও সাইট ইন্টেলিজেন্স ওয়েবসাইটে তাদের একে-৪৭ রাইফেল হাতে কালো পাঞ্জাবি পরা ছবি প্রকাশ করে। সবাই ইংরেজি

মাধ্যম স্কুলের ছাত্র : এদিকে আমাক নিউজ এজেন্সি, সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের ওয়েবসাইট এবং পুলিশ হামলাকারীদের যে নাম ব্যবহার করেছে তার সঙ্গে তাঁদের আসল নামের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নিহত জঙ্গিরা হলেন আকাশ, বিকাশ, ডন, বাঁধন ও রিপন। তবে তাঁদের পরিচয় বিস্তারিত জানানো হয়নি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিহত হামলাকারী পাঁচজনের নানা সময়ের ছবি দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের ফেসবুক আইডিও প্রকাশ করছে অনেকে। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম নিব্রাস ইসলাম, যিনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন। ছবি প্রকাশের পরই তাঁর বন্ধুরা শনাক্ত করেন তাঁকে। রেস্তোরাঁয় আড্ডা, পার্টিসহ বিভিন্ন জায়গার ছবি আছে নিব্রাস ইসলামের আইডিতে। আরেকজনের নাম মীর সাবিহ মুবাশ্বের। তিনি স্কলাস্টিকার ছাত্র ছিলেন। এ-লেভেল পরীক্ষার আগে গত মার্চ মাস থেকে নিখোঁজ হন তিনি। নিহত আরেক হামলাকারী রোহান ইমতিয়াজ এক রাজনীতিবিদের ছেলে বলে ফেসবুকে অনেকে উল্লেখ করেছেন। তিনিও স্কলাস্টিকার ছাত্র ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে বাবার সঙ্গে তাঁর ছবি দেখা গেছে ফেসবুকে। আরেকজনের নাম রাইয়ান মিনহাজ। মালয়েশিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক শেষ করেন রাইয়ান। আগা খান স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি।

এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, নিব্রাসের ফেসবুকে একজন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতার সঙ্গে সেলফি রয়েছে। ভারতের অভিনেত্রী শ্রদ্ধা কাপুরের সঙ্গে হাত ধরে নাচানাচির ছবিও রয়েছে। অবশ্য নিব্রাস ও তাঁর বোনের ফেসবুক গতকাল থেকে ডি-অ্যাক্টিভ পাওয়া যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, গুলশানের ওই রেস্তোরাঁয় হামলায় নিহতদের তিনজনই স্কলাস্টিকার ছাত্র ছিলেন। বাকি দুজনের একজন আগা খান, আরেকজন ছিলেন মানারাতের শিক্ষার্থী। তাঁরা সবাই তাঁদের পরিবারের কাছে নিখোঁজ ছিলেন। সূত্র জানায় গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে, রাজধানী থেকে এভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া তরুণের সংখ্যা কম নয়। মিরপুর ডিওএইচএসে বসবাসরত এক সাবেক সেনা কর্মকর্তার মোধাবী সন্তান নিখোঁজ রয়েছেন দীর্ঘদিন। তিনি তাঁর বাবাকে একটি চিরকুটে লিখে গেছেন, ‘আমি নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাচ্ছি।’ ধারণা করা হচ্ছে, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার্থী তরুণরাই এখন জঙ্গি নিয়োগকারীদের মূল টার্গেট। পরিবার থেকে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এসব তরুণের প্রথম গন্তব্য হয় মালয়েশিয়া। সেখানেই তাদের মগজ ধোলাইসহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের কাজ সম্পন্ন হয়।-কালের কণ্ঠ



মন্তব্য চালু নেই