মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত লাল জিপের গল্প

হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ছাদে এখনো পড়ে আছে সেই জিপটি। যার সঙ্গে জড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনাবহুল স্মৃতি। কড়া লাল রঙের জিপটি রোদ-বৃষ্টির ঝাপটা সইতে সইতে এখন বিবর্ণ।

মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ১৯৭১ সালে। দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়। পেরিয়ে গেছে ৪৪টি বছর। এরমধ্যেও সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়নি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত লাল জিপটির। ছাদে খোলা আকাশের নিচে পরিচর্যাবিহীন ও অযত্নে অবহেলায় জীপটি আজ জীর্ণদশায়।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ফোর হুইলার আট আসন বিশিষ্ট লাল টকটকে এ ‘টয়োটা’ জিপটি কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা দিয়েছেন। শুধু তাই নয় এ জিপটিতে আরোহন করেছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক জেনারেল এমএ রব, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও।

তৎকালীন সময়ে জিপটি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, সাদিপুর, শেরপুর রণক্ষেত্র, ভারতের খোয়াই, আগরতলা ও কৈলাশ শহরসহ বিভিন্নস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াত, অস্ত্র আদান-প্রদান এবং খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল।

যুদ্ধের পর সেই জিপের স্থান হয় জেলার প্রশাসকের গ্যারেজে। সেখানে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার পূর্বে ‘চেতনায় ৭১ হবিগঞ্জ’ এর সদস্য সচিব বর্তমান মহিলা আসনের এমপি কেয়া চৌধুরীর চেষ্টায় জিপটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ছাদে সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। এরপরে এটির উপরে কোন শেড না থাকায় রোদ-বৃষ্টিতে নষ্টই হয়েছে শুধু।

এরপর দফায় দফায় এটি সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে অনেকবার বলেছেন কেয়া চৌধুরী। লাভ হয়নি। এমপি হওয়ার পর তিনি জিপটি সংরক্ষণের জন্য জেলা পর্যায়ে সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এতেও লাভ হয়নি।

অবশেষে তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে দেখা করে হবিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই জিপটি, বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাপত্রের মূল কপিসহ আরও কিছু স্মারক সংরক্ষণের দাবী জানান। এতে তারা সাড়া দিলে হবিগঞ্জে পরিদর্শন করতে আসেন জাতীয় জাদুঘরের কিপার আনজালুর রহমান, ডিসপ্লে অফিসার মোঃ ইলিয়াছ খান ও স্থাপত্য নকশাবিদ রেজাউর রহমান।

তারা প্রথমেই ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী স্মৃতি পাঠাগার’ পরিদর্শন করে আসেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত লাল জিপ দেখতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। এ সময় এমপি কেয়া চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত লাল জিপ২

জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি অবগত ছিলাম না। যাই হোক এটি সংরক্ষণের চেষ্টা করব।’ এরপর জাতীয় জাদুঘরে টিম মুক্তিযুদ্ধকালীন টেজারি অস্ত্রাগার (বর্তমানে জেলা তথ্য অফিস) পরিদর্শন করেন। কিন্তু অস্ত্রাগারটি সিলগালা থাকায় ভেতর তারা দেখতে পারেননি।

তাৎক্ষণিক গাড়ীটি দ্রুত সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন টেজারি অস্ত্রাগার দেখার জন্য একটি ডিও প্রদান করেন এমপি কেয়া চৌধুরী।

তিনি জানান, ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (তারবার্তা) আসে তার পিতার কাছে। এ ঘোষণাপত্রসহ সংক্ষণের অভাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত জিপ, মুক্তিযুদ্ধের বহু স্মারক পড়ে রয়েছে হবিগঞ্জে।

তাই তার পিতা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী কতৃক রেখে যাওয়া জমিতে জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ সফল করতে পরিকল্পনা মন্ত্রী ও সংস্কৃতি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে তারা ইতিবাচক সাড়া দেন। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় জাদুঘরের এ টিমটি পরিদর্শনে এসেছে। এখানে যাদুঘর হলে এগুলো সংরক্ষণ করা যাবে। আর নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস জানতে পারবে।

জাতীয় জাদুঘরের কিপার আনজালুর রহমান জানান, সংস্কৃতিমন্ত্রীর নির্দেশে তারা স্থানটি পরিদর্শন করেন। এ ব্যাপারে তিনি ইতিবাচক প্রতিবেদন দিবেন। তিনি জানান, জাদুঘরটি হলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত একটি জীপ গাড়ীসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মারক সংগ্রহ করা যাবে। তিনি আরও জানান, জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংরক্ষণ ছাড়াও থাকবে লাইব্রেরি, সেমিনার হল, কয়েকটি গ্যালারি।



মন্তব্য চালু নেই