মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মাত্র সাতজন !

সিরাজী এম আর মোস্তাক: মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের কোনো তালিকা নেই। বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র সাতজন শহীদের তালিকা করে গেছেন। তিনি উক্ত সাতজন শহীদকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব প্রদান করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে এ সাতজনই প্রকৃত শহীদ। আর উক্ত ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের সংখ্যাটি আপেক্ষিক মাত্র। বঙ্গবন্ধু সেটিও প্রমাণ করে গেছেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ঘোষণা করেন যে, “সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি তাদের ত্রিশ লাখ শহীদের জীবন ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। আজকের বাংলাদেশ তাদেরই। তারা সবাই এক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।” এ বাক্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দেশের সবাইকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করেছেন। সে হিসেবে সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধার বিপরীতে ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যাটি মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এর মধ্যে ৬৬৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাতজন বীর শহীদকে বঙ্গবন্ধু বিশেষ খেতাব দিয়েছিলেন। এটিই মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের প্রকৃত তালিকা হিসেবে আজও বাংলাদেশে সমাদৃত রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অসাধু রাজনীতিবিদগণ নিজেদের স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের তালিকা নবায়ন করেছে। তারা দেশের মানুষকে অন্যায়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা, অমুক্তিযোদ্ধা, শহীদ, আত্মত্যাগী, পাকিস্তানী দালাল ও ভারতীয় দালাল নামে অযথা বিভাজন করেছে। তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিবর্জন করে ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে স্বীকৃতি বঞ্চিত করেছে। তারা প্রায় দুই লাখ ভারতীয় দালালদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। অথচ ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যাটি যথার্থই রেখেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি তা পুনরাবৃত্তি করেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রমহারা দুই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগ অস্বীকার করে মাত্র ৪১ নারীকে বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়েছেন। অথচ তিনি তার সকল বাণীতে উক্ত দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকেন। এ দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও ৪১ বীরাঙ্গনার তালিকাটি ত্রিশ লাখ শহীদের তুলনায় একেবারেই নগন্য হয়েছে। এতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে যারা যুদ্ধ করে শহীদ হন, তারা যোদ্ধা এবং শহীদ দুইই। আর যারা গাজী বা ভুক্তভোগী হন, তারা শুধু যোদ্ধা। যোদ্ধা না হলে কেউ কি কখনো শহীদ স্বীকৃতি পায়? অর্থাৎ, যোদ্ধা ও শহীদ ভিন্ন নয়। সব শহীদই যোদ্ধা, কিন্তু সব যোদ্ধা শহীদ নয়। শহীদের চেয়ে যোদ্ধা সংখ্যা কি কখনো কম হয়? যোদ্ধাদের মধ্যে তো শহীদ, গাজী, আহত ও বন্দী সবই থাকে। তাদের কতক শহীদ হয়, কতক বন্দী হয় আর অনেকে হয় গাজী। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও তো তাই হয়েছে। এদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির মধ্যে ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছে, দুই লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে, বঙ্গবন্ধুসহ প্রায় পাঁচ লাখ বাঙ্গালি বন্দী দিন কাটিয়েছে, প্রায় এক কোটি বাঙ্গালি ভারতে শরণার্থী হয়ে মানবেতর দিনাতিপাত করেছে এবং অবশিষ্ট সকল বাঙ্গালি দেশে অবস্থান করে যে যেভাবে পেরেছে, প্রাণপণ লড়াই করেছে। তারা প্রত্যেকে এক একজন মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু এ সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। এরপরও মাত্র দুই লাখ ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেলেন কিভাবে? তাদের পরিবারকে মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলো কেন? তাদেরকে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধার নামে দেশের সকল চাকুরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে অবৈধভাবে প্রাধিকার দেয়া হলো কেন? আর শহীদ পরিবারগুলোকে বঞ্চিত করা হলো কেন? এসবই হয়েছে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি করার কারণে।

আজ অনেকে ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যাটি মানেন, অথচ ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে মুক্তিযোদ্ধা মানেন না, তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধই মানেন না। আবার অনেকে ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যা স্বীকার করেন, অথচ দুই লাখ মুক্তিযোাদ্ধা ও ৪১ বীরাঙ্গনার তালিকাও স্বীকার করেন. তারাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অস্বীকার করেন। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক, মহা বিতর্ক।

অনেকে বলে থাকেন, বঙ্গবন্ধু ভুল করে শহীদের সংখ্যা তিন লাখের পরিবর্তে ত্রিশ লাখ বলেছিলেন। বাঙ্গালি জাতির জনকের প্রতি এ ধরণের হীন অপবাদ আরোপ করা ঠিক নয়। তাঁর চিন্তাশক্তি ছিল আকাশের মতোই পরিব্যাপ্ত। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, একজন মা তার নিজ শহীদ সন্তানের জন্য অন্য লাখো শহীদের চেয়ে বেশি কষ্ট পান। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশে উক্ত শহীদদের সংখ্যাটি কোনো মুখ্য বিষয় নয়। তাদের তালিকা প্রণয়ন করাও সমীচীন নয়। তাই বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধার বিপরীতে স্বাভাবিকভাবেই ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যাটি ঘোষণা করেন। উক্ত ত্রিশ লাখ শহীদ ও যোদ্ধার সাথে তিনি যদি তিন কোটি যোদ্ধা বা শহীদও ঘোষণা করতেন, তবু তা বেশি হত না। কারণ, এ সংখ্যা দ্বারা মুক্তিযুদ্ধে ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির সম্মিলিত প্রচেষ্টাকেই বুঝানো হয়েছে মাত্র। এতে ভুলের অবকাশ নেই।

অনেকে বলে থাকেন, বঙ্গবন্ধু শহীদদের তালিকা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। উক্ত কমিটির তদন্তে মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত শহীদের সংখ্যা মাত্র দুই লাখ উনসত্তুর হাজার উদ্ধৃত হয়েছে। এটিও আজ অসত্য প্রমাণ হয়েছে। বর্তমানে কোটাভোগী মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা সব মিলে প্রায় দুই লাখ। প্রচলিত কোটাভোগী মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা উদ্ধৃত শহীদের সংখ্যার চেয়ে কম হলো কিভাবে? এটি কি যুদ্ধনীতি পরিপন্থি নয়?

অতএব, সকল সংশয় ও বিতর্ক দুর করে বর্তমানে প্রচলিত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতি বাতিল করলেই মুক্তিযদ্ধে শহীদের প্রকৃত সংখ্যাটি সুস্পষ্ট হবে। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদের তালিকাই চুড়ান্ত বলে গণ্য হবে। ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করবেনা। দেশের ষোল কোটি নাগরিক সকল ভেদাভেদ ভুলে নিজেদেরকে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিবে।



মন্তব্য চালু নেই