মুখ খুললেন সেই বেদের মেয়ে

তারকাদের জীবনটা নদীর মতো। কখনো প্রবল স্রোত আবার কখনো ভাটা। একজন অভিনেত্রীর জীবন রূপকথার রানীদের মতো। যতটা জৌলুসে ভরা মনে হয় সত্যি কি তাই?

এক সময়ের ঢালিউডের সাড়া জাগানো অভিনেত্রী যাকে সবাই ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ নামে জানেন, চেনেন। সেই অনজু ঘোষের কথা বলছি।

আশি-নব্বইয়ের দশকে পর্দা কাঁপানো অনজু দীর্ঘদিন কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ঢাকার রুপালি পর্দার প্রবল জনপ্রিয়তা পেছনে ফেলে কলকাতার ফিল্মে নিজেকে তুলে ধরেন।

জনপ্রিয়তার নিরিখে যদি বিচার করা হয়- সত্যি কি অনজু বাংলাদেশের ফিল্মের মতো নিজের অভিনয় প্রতিভাকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন কলকাতার ফিল্মে?

ঢাকার যে অনজু রাতদিন বছরজুড়ে রুপালি পর্দায় নিজেকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, যার ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল।

এ সবকিছুকে পায়ে ঠেলে তখন কেন তিনি কলকাতার ফিল্মে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন, এ প্রশ্ন বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের সবার।

এসব প্রশ্ন পর্ব নিয়েই দীর্ঘদিন পর অনজু সম্প্রতি মুখ খুললেন কলকাতার সল্ট লেকের বাসায় এক সন্ধ্যায়। এ প্রতিনিধি ঢাকায় যে অনজুকে অতীতে দেখেছেন একজন উচ্ছ্বল মুখর, আজ সেই অনজু অনেকটা অভিমানী, স্থির।

সবকিছুতেই মনে হলো যেন অনীহা। অতীত থেকে পালিয়ে বেড়াতে চান। এত জনপ্রিয়তা, রুপালি পর্দার একসময়ের এত অর্জন- সবকিছু থেকেই দূরে থাকার প্রয়াস।

অনজুর জিজ্ঞাসা- আর কি হবে আমার কথা জেনে। সত্যি, সবকিছু আজকাল মরীচিকা মনে হয়। যে চলচ্চিত্রের জন্য নিজের শৈশব, যৌবনের সব চাওয়া-পাওয়া উপেক্ষা করলাম, তার বিনিময়ে কি পেলাম?

হিসাবের খাতা যে পুরোটাই শূন্য তা বলবো না। কিন্তু পাওয়ার জায়গাটা খুব মনের মতো নয়। সেটা কিন্তু অর্থের কথা নয়, কথা সম্মানের। ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ যখন বাংলাদেশে অতীতের সব ছবির রেকর্ড ভেঙে দিল, কই তখন তো অনজুকে মূল্যায়ন করেনি- কোন সংগঠন বা সরকার।

বরং বারবার অনজু নামের আগে অশ্লীল তকমা জুড়ে দিয়েছে। আমি ঢালাওভাবে সবার কথা বলছি না। আমিও তো স্বীকার করি- অনজু সৃষ্টি বাংলাদেশের ছবিতে।

যেখানে আমি ‘আশীর্বাদ’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘আয়না বিবির পালা’র মতো সৃজনশীল ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছি। কিন্তু কিছু সংবাদপত্র, ফিল্মের কিছু লোক- বারবার অনজুকে অশ্লীল নায়িকা বলে গলা ফাটিয়েছেন।

‘বেদের মেয়ে জোছনা’র জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে যখন কলকাতার প্রযোজক-পরিচালকরা আমাকে নিয়ে একে একে পশ্চিমবঙ্গে ছবি বানালেন, অর্থকড়ির মুখ দেখলেন- একটা সময় তারাও নিজেদের ষোলোআনা বুঝে আমার দিক থেকে মুখ ফেরালেন।

কলকাতার অভিনয় ব্যস্ততার কারণে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাথে যোগাযোগ কমে গেল। একটা সময় একদম নাই হয়ে গেল।

পারিবারিকভাবেও আমি একা হয়ে গেলাম একটা সময়। প্রথমে বাবা, তার কিছুদিন পর মা স্বর্গবাসী হলেন। যে মায়ের হাত ধরে আমার এ পৃথিবীতে চলা, আমার সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা, আমার সুখ- তার চলে যাওয়া আমার জীবনে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করলো।

এ সুযোগে যাদের আমি আপন ভাবতাম তারাই আমার সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করলো। আমি যখন কলকাতায় জনপ্রিয়, তখনই কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী আমার বিরুদ্ধাচারণ শুরু করলো।

তারা বলতে শুরু করলো, বাংলাদেশ থেকে এসে অনজু কলকাতার ছবিতে কীভাবে কাজ করে দেখবো। মানুষের যে কত রূপ হতে পারে বিপদে পড়ে আমি দেখেছি।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে অনজু বলেন, তুমি যে নায়িকাকে দিদি বলছো, এই দিদিই সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছে আমার ব্যাপারে। যারা স্বগোত্রীয়কে সম্মান জানাতে পারে না তারা আবার কার কি উপকার করবে ভগবান জানে। তবুও আমি তাদের মঙ্গল কামনা করি।

তুমি যে আজ বাড়িতে বসে আছো তার প্রতিটি বালু কণায় ফিল্মের অর্থ আর আমার শ্রম রয়েছে। অনজু ঘোষ কি চিরকুমারী- এই প্রশ্নে কিছুটা ধোঁয়াশা। তার জীবনে কি বিয়ের সানাই বাজেনি।

বাংলাদেশের এক সময়ের জনপ্রিয় তারকা কাগজ চিত্রালীতে তার বিয়ের খবর প্রকাশ পায়। যার চলচ্চিত্র দিয়ে অনজু লাইমলাইটে এসেছিলেন সেই ‘সওদাগর’ ছবির পরিচালক এফ কবীর চৌধুরীকে বিয়ে করে অনজু ধর্মান্তরিত হয়েছেন।

অথচ যে রাতে তার বিয়ে হয় তার পরদিনই সে বিয়ে তিনি অস্বীকার করেন অনজু। দীর্ঘদিন ঢাকা চলচ্চিত্র ও মিডিয়া এ বিয়ের খবর নিয়ে মুখর ছিল। এ নিয়ে এফ কবীরের সঙ্গে অনজুর দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

এ বিয়ের খবর আকাশে পাখা মেলতে না মেলতেই আবার মাহমুদ কলির সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন অনজু। দুর্ভাগ্য এ প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি। কিন্তু মাহমুদ কলির সঙ্গে সত্যি মনের ভাব হয়েছিল।

এক্ষেত্রে মাহমুদ কলি অনজুকে ধোঁকা দিয়েছেন- এটা ধ্রুবতারার মতো সত্য। এরপর অনজু ওই পথে আর পা বাড়াননি। আজও রয়ে গেছেন কুমারীর কাতারে।

অতীত কি হাতছানি দেয় না? অতীতকে কেউ ভুলতে পারে? জীবনের প্রথম প্রেম ভালোলাগা তো বইয়ের ভাঁজে সযত্নে রেখে দেয়া গোলাপ ফুলের মতো। সেটায় সুবাস থাকে না। কিন্তু দু’টি হৃদয়ের ছোঁয়া রয়ে যায় আমৃত্যু।

হঠাৎ অনজুর জিজ্ঞাসা শবে বরাত কবে। বললাম কেন? তিনি বললেন, এই দিনে আমি রোজা রাখি। ঢাকায় যখন থাকতাম- সবাইকে নিয়ে ইফতার করতাম।

নিজের প্রোডাকশন হাউজ করেছিলেন ‘আশীর্বাদ চলচ্চিত্র’- তার খবর কি জানতে চাইলাম। বললেন, ঘটা করে নতুন ছবির মহরতও করেছিলাম। কিন্তু কিছু লোকের অসহযোগিতার কারণে ছবির কাজ শেষ করতে পারিনি।

ঢাকার নায়িকা অঞ্জনা, কলকাতায় ‘প্রাণ সজনী’ নামে ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। যার নায়িকা অনজু। সেই ছবিও কলকাতায় হিট করে। অনজু ঢাকার রাজ্জাক, আলমগীর, ওয়াসিম, জাফর ইকবাল, ফারুক, মাহমুদ কলি, জাভেদ- সবার বিপরীতে অনেক ছবিতে অভিনয় করেন। অনজু-ওয়াসিম জুটি অনেক ব্যবসা সফল ছবি উপহার দেন।

উল্লেখ্য, অনজুর বেশির ভাগ ছবির গান জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যেমন: কি জাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা, আমি নদীর সাথে দেব না তোমার তুলনা, এই বৃষ্টিভেজা রাতে চলে যেও না, বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে- সেটা চলচ্চিত্রের ইতিহাস।

অনজু বললেন, মিডিয়ার প্রতি তখনকার শিল্পীরা সব সময় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। পত্রিকার পাতায় নিজেদের একটি সুন্দর ছবি প্রকাশ হলে কি যে আনন্দ হতো বলে বুঝানো যাবে না।

প্রথম যেদিন এফডিসিতে শুটিং করলাম কি যে ভয় সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমি যখন এলাম তখনও তো শাবানা, ববিতা, কবরী ম্যাডামরা ফিল্মে রাজত্ব করে চলেছেন।

অঞ্জনা, রোজিনা, দিলারা, চম্পা, সূচরিতা- তারাও সমান তালে কাজ করে চলছেন। এদের সবার মাঝে আমার মতো আনকোরা একজন হঠাৎ ফিল্মে চলে আসা এবং সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করা কি দুঃসাহস আমার।

আমি সৌভাগ্যবতী চলচ্চিত্রের লোক, মিডিয়াকর্মী- সবার সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে সাফল্য আমার কাছে ধরা দেয়। আনন্দ বিচিত্রার শ্রদ্ধেয় শাহাদত চৌধুরীর প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ।

কারণ উনার ম্যাগাজিনে সহজে কেউ প্রচ্ছদ-কন্যা হতে পারতেন না। উনার শুভ দৃষ্টির ফলে আমিও আনন্দ বিচিত্রার প্রচ্ছদ-কন্যা হওয়ার সুযোগ পেলাম। আর সাপ্তাহিক চিত্রালী ও পূর্বাণী- সেটা তো ফিল্মের লোকের ধ্যানজ্ঞান।

প্রতি রোববার অপেক্ষায় থাকতাম চিত্রালীর জন্য। তার চুম্বক অংশ থাকতো হাওয়া থেকে পাওয়া। শিল্পীদের গোপন খবর থাকতো এই অংশে। আমরা সবাই ভয়ে থাকতাম। বিশেষ করে খোকা ভাই আর ফটো সাংবাদিক বেলাল- সেটে এলেই আমরা সবাই নড়েচড়ে বসতাম।

সাবধান হতাম। খোকা ভাই যেমন শিল্পীদের ভুল ধরে দিতেন তেমনি বিপদে সবার আগে পাশে দাঁড়াতেন। অভিভাবক হিসেবে পরামর্শ দিতেন। আর আওলাদ-শরীফ জুটি ছায়াছন্দ ম্যাগাজিনের প্রাণ।

সাংবাদিকতা জগতে দুই তরুণ তুর্কী। চলচ্চিত্র শিল্পের অন্ত্যপ্রাণ। আজ খোকা ভাই নেই, বেলাল, আওলাদও নেই। কত যে স্মৃতি এদের নিয়ে। -এমজমিন



মন্তব্য চালু নেই