‘মুজিবের রক্তাক্ত বিরোধিতা করেছি, পতন চেয়েছি’ (ভিডিও)

১৯৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত জাসদের ভূমিকা, বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত বিরোধিতা এবং বিপ্লবের জন্য জিয়াউর রহামানকে নির্বাচন করা যে কর্নেল তাহেরের ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো সে বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন জাসদ নেতা মঈন উদ্দিন খান বাদল। একইসঙ্গে জোট সরকারের মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও জাসদের ভূমিকা নিয়েও তিনি বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন।

জাসদের শরীফ নুরুল আম্বিয়া অংশের কার্যকরী সভাপতি ও চট্টগ্রাম ৮ আসনের এ সংসদ সদস্য সম্প্রতি লন্ডন সফরের সময় চ্যানেল এস টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য দেন। চ্যানেলটির ‘অভিমত’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত সাক্ষাৎকারটি গত ২২ ফেব্রুয়ারি গ্রহণ করেন তানভীর আহমেদ। সমসাময়িক অবস্থা বিবেচনায় সাক্ষাতকারটি আওয়ার নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

জাসদের গণবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ এসেছে, আপনি কি বিষয়টি পরিষ্কার করবেন?

বাদল: এগেইন আই উইল গো টু মাই পার্লামেন্ট। আমরা ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত সরকারের বিরোধিতা করেছি, প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছি, রক্তাক্ত বিরোধিতা করেছি। সেই বিরোধিতায় আমরা সরকারের পতনও চেয়েছি। সেই চাওয়ার প্রক্রিয়ায় আমরা মরেছি এবং মেরেছি। এই যে বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর, দ্য পলিটিকস অব জেএসডি ও অন্যদের পলিটিকস, হুইচ ইজ রাইট, হুইচ ইজ রং। এটা ইতিহাসকে সিদ্ধান্ত নিতে দেন। আমি এর বাইরে কোনও মন্তব্য করবো না।

৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত আপনারা যে সরকারের বিরোধিতা করলেন, সেই আদর্শের সরকারে আপনারা এখন অংশীদার কেমন করে?

বাদল: ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত জাসদ যে একদলীয় সরকারের বিরোধিতা করেছিলো, সেই একদলীয় শাসন ব্যবস্থা নিশ্চয়ই এখন নেই। জাসদের ওই সময়ের অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি যে আমরা স্বীকার করিনি তা নয়। এখন যে জিনিসটা আপনারা লক্ষ্য করেছেন সেটা হলো- আমরা একটা জোট গঠন করেছি একটা বৃহত্তর লক্ষ্যকে জাস্টিফাই করার জন্য। আমরা সিরিয়াসলি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর বিশ্বাস করে যদি এগিয়ে যাওয়া না যায় তাহলে দেশ এগোবে না।

মুক্তির চেতনা নিয়ে যে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করলো ১৯৭১ সালে, ৭২ সালে এসেই কেন আপনারা সেই চেতনার বিরোধিতা শুরু করলেন?

বাদল: আপনি আবারেও সেই প্রশ্নে ফিরে এসেছেন, আমি যেটার উত্তর দিতে চাই না। সেটা হলো- ৭২ থেকে ৭৫- এর পৃষ্ঠাগুলো একের পর এক উল্টালে এটার উত্তর মিলবে, কেন আমরা প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলাম।

তাহলে আপনারা কি সেই দায়টি নেবেন? আপনাদের প্রতিবাদের কারণে যে ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছিলো তার পরবর্তী সময়ে ৭৫ সালে বাংলাদেশে কলঙ্কিত অধ্যায়টি তৈরি হয়েছে (বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড)।

বাদল: সেটা, ক্ষেত্র প্রস্তুতের কথা যদি বলেন, আমি তো নিজের মুখে স্বীকৃতি দিচ্ছি, আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পতন চেয়েছি এবং খুব তারস্বরে বলছি, যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে জাতীয় সামাজতান্ত্রিক দলের কোনও দেনা পাওনা নাই।

তাহলে জাসদের হাতে যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে তার তো কোনও বিচার হয়নি বাংলাদেশে।

বাদল: আমি বলেছি, হত্যাকাণ্ড হয়েছে, আমার বাংলাটা পরিষ্কার করে শুনেছেন কিনা জানি না। আমরা মরেছি, আমরা মেরেছি। সব ব্যাপারেই যদি পুনর্বার ওপেন করতে চান…। যদি কখনও সেটা ইতিহাসে ওপেন করেন, নো প্রোবলেম। সেটা ওপেন হতেই পারে, সব বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

সেই সময়ে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে খালেদ মোশারফ সরকারের পতন এবং জিয়াউর রহমানের প্রতিবিপ্লবের ঘটনা নিয়ে আপনার অনুশোচনা রয়েছে কি না?

বাদল: একটি কথা বলি, কর্নেল তাহেরকে দিয়ে বা জাসদ কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে যে পিরিয়ডটিতে আমরা আমাদের বিপ্লব বিবেচনা করেছিলাম, তখন প্রতিদিন সেনাবাহিনীতে নানা রকম বিক্ষোভ বিদ্রোহ হচ্ছিল। সেনাবাহিনী, ইট ইজ এ স্টেইট উইথইন দ্য স্টেইট। সেই স্টেইটটাই ভেঙে যাচ্ছে, না না রকম গ্রুপিং হচ্ছে। সুতরাং আমাদের বিবেচনাবোধ ছিলো, এই প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত আসবে। সেই বিবেচনাবোধ থেকেই আমরা রুখে দাঁড়িয়েছি। সেই রুখে দাঁড়ানো, সেই আমাদের এটেমডটা কি ইনফ্রেন্টাল ডিসঅর্ডার? আমাদের এডেমডটা কি অতি বিপ্লবীপণা? ইতিহাস বিবেচনা করবে, আমরা কি প্রস্তুতিহীন অবস্থায় আক্রমনে চলে গেছি? এই জায়গাগুলো ইতিহাস খোল নলচে দেখার চেষ্টা করছে। নানা জন বই লিখছেন, নানা জন মন্তব্য করছেন।

যেহেতু আপনি স্বীকার করেছেন, আপনারা বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন চেয়েছিলেন, আর বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পর পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের সরকারকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা কি আপনাদের শুরু থেকেই ছিলো?

বাদল: জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা কখনওই ছিলো না, জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো কর্নেল তাহেরের সঙ্গে, সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় আমরা কখনেও অ্যাসোসিয়েট ছিলাম না।

তাহলে কর্নেল তাহের যেহেতু জাসদের কমান্ডার ছিলেন, তাহলে তিনি কি এই দায় এড়াতে পারেন?

বাদল: আমি বলছি, সম্পর্ক ছিলো তাদের (কর্নেল তাহের-জিয়াউর রহমান) এবং বিবেচনায় এসেছে, ওই যে সেনাবাহিনীতে নানা রকম বিক্ষোভ, সেনাবাহিনীর ফেব্রিকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, কর্নেল তাহের মনে করেছেন জিয়াউর রহমান এই ফেব্রিকটা, ফেব্রিক অব আর্মি, রক্ষা করার ক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে পারবেন। কিন্তু বিপ্লবের ইতিহাস বলে, রং পার্সন চুজ করলে, খুব মর্মান্তিক পরিণতি হয়, সেই মর্মান্তিক পরিনতি তো জাসদের নিতেই হয়েছে।

বর্তমান জোটের যে তথ্যমন্ত্রী রয়েছেন, হাসানুল হক ইনুকে নিয়ে আপনাদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, এই বিষয়টি পরিষ্কার করবেন?

বাদল: আমি একটা কথা বলি, এই হাসানুল হক ইনুর ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্ন আসছে, আদতে যদি তার ভূমিকা নিয়ে এতো প্রশ্ন হয়, তাহলে কেন তাকে মন্ত্রী রাখা হয়েছে? আপনারা যদি আসলেই মনে করেন যে, তিনি এতো কিছুতে যুক্ত ছিলেন, তাহলে তাকে তথ্যমন্ত্রী রাখার মধ্য দিয়ে তো আপনারাই ভুল আচরণ করছেন। দ্বিতীয় কথা হলো, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল রাজনৈতিক বিরোধিতা করেছে। কিন্তু সামরিক যে কর্মকাণ্ডটি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাধিত হয়েছে, তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিলো না। বর্তমান সরকারতো অনেক কিছু নিয়ে ইনকোয়ারি করেছে, মাহফুজ আনামকে নিয়ে ৮০টা মামলা হয়েছে। হোয়াই ডোন্ট ইউ স্টার্ট ইনকোয়ারি। ইনকোয়ারি করলেই সবকিছু বেরিয়ে আসবে। ইনকোয়েরি করে যদি ব্যক্তিকে সামনে নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে ইনকোয়েরিতে যা হবে তাই। আমরা বলেছি, এই ঘটনার সঙ্গে আমরা কন্সিনকালেও যুক্ত ছিলাম না। আর কোনও ব্যক্তিকে যদি আপনি দোষী সাব্যস্ত করেন, সেই ব্যক্তিকে নিয়ে আপনার সরকার চলছে, আবার একদিকে দোষী সাব্যস্ত করছেন, ‘টু থিংস ক্যান নট গো টুগেদার’।

সেই সময় থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, এই প্রক্রিয়ার পেছনের কারিগর হিসেবে অনেক সময় জাসদকে দায়ী করা হয়। জাসদ সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় বসার একটি পথ তৈরী করেছিলো বলেই ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, এই যুক্তিকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

বাদল: আমরা সেনাবাহিনীর যাদের নিয়ে কাজ করতাম, তারা কখনেও ক্ষমতায় টমতায় আসে নাই। জাসদের যদি আদৌ সেনাবাহিনী নিয়ে কোনও কাজ কারবার থাকে, সেগুলো সৈনিক, হাবিলদার, সুবেদার, পর্যন্ত। সুতরাং ওইটা আমাদেরকে দোষারোপ করে লাভ নাই। যেই একের পর এক চক্রান্ত দেখেছেন, এই চক্রান্তকারীদের সঙ্গে জাসদের সম্পর্ক ছিলো না। আপনার মাধ্যমে এটা সবাইকে মনে করাতে চাই। আমরা যে সংস্থা গড়ে তুলেছিলাম, যেটার জন্য আমাদের অভিযুক্ত করা হয়, সেটা হলো বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা।

গণবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর কনফ্লিকটা একটু ব্যাখ্যা করবেন?

বাদল: সেটা হলো যখন, জাসদ যখন মনে করেছে গণতান্ত্রিকভাবে আর এগোনো যাচ্ছে না, তখন ডিক্লারেশন দিয়ে উই হ্যাভ টেইক আপ আর্মস, বাই ফর্মিং গণবাহিনী। সো ন্যাচারালি, গণবাহিনী আর্মস নিয়ে এটা রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।

একটি সরকার রয়েছে, নতুন একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে, (১৯৭২ সালে) আপনাদের কেন হঠাৎ করে মনে হলো গণবাহিনী তৈরি করে সেই সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে?

বাদল: আমাদের কেন মনে হলো সেই জায়গাটাই তো আপনাকে বলছিলাম, গবেষণা করুন ইতিহাসের খাতায় খোঁজ নেন। আমাদেরও ২০ হাজার কর্মী বাংলাদেশের প্রত্যেক জায়গায় রক্ত দিয়েছে। বাংলাদেশের মাটি চাপ দিলে, আমাদেরও রক্ত বেরিয়ে আসবে।

এই জায়গাটিতে (জাসদের ২০ হাজার কর্মী হত্যার) কেন আপনারা তদন্তের জন্য বলছেন না?

বাদল: এখনই তো বললাম, আপনার সামনেই তো বললাম তদন্ত হোক, আমি যে জোটে রয়েছি আমি সেই সরকারকে বলেছি। আমি জাতীয় সংসদে বলেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বসা ছিলেন। তদন্ত হোক, সো বি ইট, লেট ইট বি ক্লিয়ার টু এভরি বডি, হু ইজ হোয়াট, অ্যান্ড হু ইজ হু। তদন্ত করেন না, আমি ওইভাবে তো সরকারে নাই, আমি সরকার পক্ষের লোক। সরকার তদন্ত কালকেই শুরু করতে পারে। অসুবিধা কী?

প্রশ্ন: তাহলে আপনি কি বলতে চাইছেন, সেই সময়ে আওয়ামী লীগের মুজিব বাহিনী কর্তৃক জাসদের ২০ হাজার কর্মী নিহত হয়েছেন?

বাদল: না, মুজিব বাহিনীর সদস্য, মুজিব বাহিনী কর্তৃক না, আমি বলেছি, ৭২-৭৫ সময়ে জাসদেরও ২০ হাজার কর্মী মারা গেছে। সেটা বজ্রাঘাতে মারা গেছে না পুকুরে পড়ে মারা গেছে তদন্ত করলেই বেরুবে।-বাংলা ট্রিবিউন



মন্তব্য চালু নেই