মুস্তাফিজকে প্রশংসায় ভাসালেন রমিজ রাজা

বাংলাদেশ ক্রিকেটে সাম্প্রতিককালে সেরা আবিষ্কার বলে যিনি চিহ্নিত, সেই মুস্তাফিজুর রহমানের বোলিংকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন সাবেক পাকিস্তানি তারকা ও ক্রিকেট ভাষ্যকার রমিজ রাজা।

বাংলাদেশে সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আক্রমণের মুখে পড়া রমিজ রাজা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার মতে মুস্তাফিজ ক্রিকেটের দুনিয়ায় এক অসাধারণ উপহার।

বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি যে মোটামুটি সর্বসম্মতভাবে এক নম্বর ভিলেন, সেটাও রামিজ রাজার বিলক্ষণ জানা – এবং সেখানে কী কী নামে তাকে ডাকা হয় সেগুলোও দেখা গেল দিব্বি মুখস্থ আছে। কিন্তু আবার – ওই ব্যাপারে তিনি মুখ খুলবেন না।

আজকের এই প্রযুক্তির যুগে কোনও বোলারকে নিয়েই তো বেশিদিন না কি রহস্য থাকে না। কিন্তু গত বছরে অভিষেক হওয়া মুস্তাফিজুর রহমান কিন্তু এখনও ব্যাটসম্যানদের কাছে রীতিমতো হেঁয়ালি, বিশেষ করে তার বিখ্যাত কাটার ডেলিভারিটার জন্য। এ বিষয়ে রমিজ রাজা বলেন, ‘দেখুন, একটা কথা আমি খুব বিশ্বাস করি আপনি যদি ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের নজর কাড়তে পারেন তাহলে কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটের মঞ্চে আপনার ‘আবির্ভাব’ হয়ে গেছে। কারণ ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ এই মুহুর্তে দুনিয়ার সেরা – আর তারা যদি আপনাকে খেলতে না-পারে তাহলে বলতেই হবে আপনার মধ্যে তারকা হয়ে ওঠার মালমশলা আছে।

মুস্তাফিজের চমক, ওর ড্রামা কিন্তু এখনও ফুরোয়নি – কারণ ওর একটা দারুণ ক্রিকেটিং বোলিং মস্তিষ্ক আছে। অনেকটা আমাদের মহম্মদ আমেরের মতো – এই মুস্তাফিজুর, আমেরদের আসলে বেশি কিছু বলতে হয় না। ওরা ন্যাচারালি গিফ্টেড ক্রিকেটার।

মুস্তাফিজুর যেমন ধরুন এই ধোঁকাটা দারুণ দিতে পারে – ও যখন ওর নর্ম্যাল ডেলিভারিগুলো করতে করতে ওর বিখ্যাত কাটারটা করে, তখন ওর অ্যাকশনে সামান্যতম কোনও অ্যাডজাস্টমেন্ট থাকে কি না, সেটা কিন্তু ধরা খুব মুশকিল। মানে ওর স্বাভাবিক ডেলিভারির চেয়ে ওর স্লোয়ারে প্রায় কোনও পার্থক্য ধরাই যায় না।অ্যাকশন প্রায় একই রকম থাকে – পার্থক্যটা হয় ভীষণ সূক্ষ্ম। আর তা ছাড়া গতির যে রকমফের হবে, সেটাও কিন্তু ভীষণ সূক্ষ্ম হতে হবে – হঠাৎ করে বলের পেসটা বিরাট বদলে গেলে চলবে না। তাহলে ব্যাটসম্যানরা সেটা ঠিক ধরে ফেলবে। তাই আমি বলতে চাইছি, মুস্তাফিজুরের এই গোটা বিষয়টা একটা সূক্ষ্ম শিল্পকর্মের মতো – ওর বোলিং মস্তিষ্কের প্রয়োগ, কখন স্লোয়ারটা করব সেটা ঠিক করা – সব মিলিয়েই এই ব্যাপারটা।

আমি শুধু একটা পরামর্শই ওকে দেব – ওর সঙ্গে কিপারের সমন্বয়টা বোধহয় বাড়াতে হবে। মানে আমি কয়েকটা ক্ষেত্রে দেখেছি, ওর কাটারে ব্যাটসম্যান ‘এজ’ করেছে – কিন্তু সেটা কিপারের কাছে পৌঁছয়নি (ক্যারি করেনি) কারণ কিপার তখন স্লোয়ার ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে ওদের মধ্যে বোঝাপড়াটা তৈরি করতে হবে, বেসবলে যেমন সিগনাল দেওয়ার চল আছে সেভাবে ওরা নিজেদের মধ্যে একটা সঙ্কেতও চালু করতে পারে যে পরের ডেলিভারিটা স্লোয়ার আসতে যাচ্ছে। এই রকম কিছু আর কী! কিন্তু সব মিলিয়ে আমি বলব মুস্তাফিজুর অবশ্যই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ, এই খেলাটার জন্য দারুণ এক উপহার।

মুস্তাফিজের এমন ডেলিভারি কি টিটোয়েন্টি ফর্ম্যাটেও সমান কার্যকরী হবে কিনা জানতে চাইলে পাকিস্তানের প্রাক্তন এই ক্রিকেটার বলেন, ‘নিশ্চই। কারণ, ব্যাটসম্যানরা এখনও ওর রহস্য ভেদ করতে পারেনি – আর আমি নিশ্চিত মুস্তাফিজও নিজেকে আরও পরিণত করবে, আরও পাল্টে নেবে। আসলে কি, আপনি যখনই নতুন শেখা বন্ধ করে দেবেন, তখনই কিন্তু এই খেলাটায় আপনার শেষের দিন ঘনিয়ে আসবে। তবে আমি ওকে শুধু বলব, এই বুঝি ব্যাটসম্যান আমার বোলিংটা ধরে ফেলল – এসব নিয়ে বেশি মাথা না-ঘামিয়ে ও বরং ওর নতুন জীবনটা উপভোগটা করুক। এই যে এত কম বয়সে তারকার খ্যাতি পাচ্ছে তা নিয়ে চুটিয়ে আনন্দ করুক। আর এতদিন ধরে যে দারুণ বোলিংটা করে আসছে, সেটাই চালিয়ে যাক!’

বছরকয়েক আগে শ্রীলঙ্কার অজন্তা মেন্ডিস যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এলেন, তার ‘ক্যারম বল’ নিয়েও প্রচুর হইচই হয়েছিল। সেই মেন্ডিস এখন কোথায় হারিয়ে গেছেন, কেউ খবর রাখে না। মেন্ডিসের মতো মুস্তাফিজও হারিয়ে যাবে কিনা জানতে চাইলে রমিজ রাজা বলেন, ‘হ্যাঁ, মেন্ডিসের কথা দিব্বি মনে আছে। তবে আমি কিন্তু মুস্তাফিজুরের সঙ্গে ওর ঠিক তুলনা টানতে চাইব না। বরং আমি ভীষণভাবে চাই মুস্তাফিজ নিজেকে আরও উন্নত করুক – এবং আমার বিশ্বাস ও সেটা করবেও। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এই বয়সে ও যা অর্জন করেছে – এই মুহুর্তে ওর নিজের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি আর কীই বা চাওয়ার থাকতে পারে?

তবে কি, ওকে কিন্তু ফিট থাকতেই হবে। ওর চেহারাটা আর একটু বড়সড় হলে আমার বেশি ভাল লাগত। কারণ একজন ফাস্ট বোলারকে অনেক ধকল সইতে হয়, অনেক চাপ নিতে হয়। ক্রাঞ্চ টাইমে বোলিং করার চাপ শরীর থেকে অনেক কিছু নিংড়ে নেয় – ফলে ফিটনেস একশোভাগ না থাকলে খুব মুশকিল। তবে হ্যাঁ, মুস্তাফিজের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার সবে শুরু হয়েছে, বছরখানেকও বোধহয় হয়নি – আমি নিশ্চিত ও নিজেকে আরও গড়েপিটে নেবে, ওজনও একটু বাড়াবে।

আর একটা কথা কি, এই যে আহত হয়ে মুস্তাফিজকে এখন মাঠের বাইরে থাকতে হচ্ছে – এটা কিন্তু বিরাট একটা আঘাত। এত কম বয়সে আপনি কিছুতেই আনফিট হতে চাইবেন না – আর সারা দুনিয়া যখন আপনার কাছ থেকে আর একটা দুর্ধর্ষ স্পেল দেখার ভরসায় বসে আছে তখন তো কোনও মতেই নয়! ফলে আমি চাইব বুদ্ধিমান লোকজন ওর সঙ্গে কাজ করুক – যাতে মুস্তাফিজ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া আর ক্যালরিটা নিতে পারে এবং সবচেয়ে বড় কথা, যাতে বাংলাদেশের হয়ে লম্বা সময় ধরে খেলে পারফর্ম করতে পারে!

আমি বলব, মুস্তাফিজুর রহমান সবার চেয়ে আলাদা। ওর শতকরা আশি ভাগ ডেলিভারিই স্লোয়ার ডেলিভারি বা কাটার – তবু কেউ ওকে এখনও ধরতে পারেনি, ওর রহস্য ভেদ করতে পারেনি। আমি মনে করি এশিয়ার পিচে, রাফ সারফেসে ওকে খেলা সত্যিই কঠিন, খুব কঠিন। ওর জন্য আমার অঢেল শুভেচ্ছা রইল।

কার্টেসি : বিবিসি বাংলা



মন্তব্য চালু নেই