মৃৎশিল্প : ফিরে আসবে বাংলার ঐতিহ্য

হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য মৃৎশিল্পকে ফেরাতে ইউনেস্কোর রকফান্ড অ্যান্ড ট্রাস্টের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার সংলগ্ন দুটি গ্রাম মিঠাপুর ও জামালপুরের ২৬ জন মৃৎশিল্পীকে চিরাচরিত পদ্ধতিতে মৃৎপাত্র তৈরিতে অভ্যস্ত এই শিল্পীদের নিয়ে ৯ মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এ প্রশিক্ষণের অধীনে এই পরিবারকে একাধিক অনুশীলন কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এই কর্মশালায় তাঁদের পাহাড়পুরের মৃৎফলকের রেপ্লিকা, টেপা পুতুল ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি শেখানো হয়েছে। তাদের তৈরি এসব সামগ্রী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শন এবং বিক্রি করা হচ্ছে। এ ধারাহিকতায় গত ১০ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী কক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ আয়োজনে পোড়ামাটির তৈরি সামগ্রীর মেলা ও প্রদর্শনী ব্যবস্থা করা হয়। দেশের ধংসপ্রায় হেরিটেজ সাইট পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের কেটসই উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থায়ীয় কারুশিল্পী সম্পৃক্ত করে পণ্য তৈরির এ প্রকল্প ব্যস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প।

এসময় এ শিল্পের শিল্পীদের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি মাটির হাঁড়ি, পাতিলসহ নানা কাজে ব্যবহৃত গৃহস্থালি জিনিসপত্রের বিরাট কদর ছিল গ্রামবাংলার মানুষের কাছে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির শিল্প বিকাশের ফলে এদের কদর নেই বলেই চলে। তবে এ বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলার হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রকল্পের দ্বায়িত্বে থাকা ইউনেস্কোর প্রতিনিধি কিযি তাহনিন জানান, এ শিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি আমরা। এ শিল্পের সাথে জড়িত পরিবারকে স্বাবলম্বী করে দেওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য। পাশাপাশি শিল্পীদের সাথে মার্কেটের যোগাযোগ তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু বড় প্রতিষ্ঠান শিল্পীদের থেকে নিয়মিত মৃৎ-পণ্য নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিযি তাহনিন বলেন, ‘আশার ব্যাপার হচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ শিল্পীদের নিজ এলাকায় দোকান তৈরি করে দেবে, যাতে তাঁরা সেখানে নিজেদের তৈরি পণ্য স্বাচ্ছন্দ্যে বিক্রি করতে পারেন।

আরেক কর্মকর্তা বলেন, এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য হলো বৃহত্তম বাজারের সঙ্গে তাদের কাজকে পরিচিত করানো। এছাড়া মৃৎশিল্পীদের কাজ নগরজীবন অভ্যস্থ মানুষকে নতুনভাবে ভাবতে আগ্রহী ও উৎসাহী করা। এছাড়া গ্রামীণ মৃৎশিল্পীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ তৈরির সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং সরকারের মাধ্যমে এসব শিল্পীদের সার্বিকভাবে সহিযোগিতা করব। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের দেশের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসতে বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। এই প্রিয় কাজকে আমি স্বাগত জানায়। আমি তাদের কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি।

এই প্রকল্পের থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া কমলা রানী পাল জানান, ছোটবেলা থেকেই মাটির জিনিস তৈরিতে পারদর্শী তিনি। কারণ তার বাবা-মাও এ পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। জীবিকার তাগিদে ৪৯ বছর বয়সেও মৃৎশিল্পের কাজ করেন তিনি। তার বৃদ্ধ স্বামী এক সময় এ কাজ করতেন।

কিন্তু বয়সের ভারে এখন আর সেই ক্ষমতা তার নেই। কমলা রানীর দুই ছেলে এবং তাদের স্ত্রীরা কেউ এ পেশার সাথে জড়িত না। ছেলেরা কিছু কারিগরি কাজ শিখে নিজেদের পেশায় স্বাবলম্বী। তিনি জানান, এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা অনেক নতুন বিষয় শিখতে পেরেছি। প্রশিক্ষণের মাধামে নিজ এলাকায় একটি দোকান দিয়েছি। সেই দোকানে আমার ছেলে বসে।

গত মঙ্গলবার প্রদর্শনীর শেষদিন ছিল। গ্যালারিতে ঢুকতেই মাটির গন্ধ অনুভব হয়। সেখানে থরে থরে সাজানো আছে পোড়া মাটির হাড়ি, পিঠার পাতিল, তৈজসপত্র, ঘর সাজানোর পুতুল, মাটির ব্যাংক এবং আরো নানান জিনিসপত্র। সেই সঙ্গে কিছু পাটের ব্যাগও প্রদর্শন করা আছে। মৃৎশিল্পীরা তাদের স্টলে বসে কেউ নিজের হাতে তৈরি পুতুল রঙ করছেন, আবার কেউ কেউ ভেজা মাটি দিয়ে নকশা করে পুতুল তৈরি করছেন। প্রদর্শনীতে একটু সময় করে ঢুঁ মারতে পারলে শহুরে কৃত্রিমতা ভুলে গিয়ে গ্রামের সরলতা অনুভব করা যাবে।

প্রদর্শনীর আরেকজন শিল্পী কার্তিক পাল এ পেশায় আছেন ছোটবেলা থেকে। তারও বাবা-মায়ের মাধ্যমেই এ পেশায় হাতেখড়ি।

তিনি জানান, এ পেশায় তিনি নিজের সন্তানকে আনবেন না। তাই সন্তানকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তবে এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ কষ্টের পেশার ভবিষ্যৎ দেখছেন কার্তিক পাল। তাঁর মতে, প্লাস্টিক এবং অ্যালুমিনিয়ামের এই যুগে মাটির জিনিসের কদর কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, মৃৎশিল্পে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে ফিরে আসবে প্রচীন বাংলার হারানো ঐতিহ্য।

এই প্রদর্শনীতে ঘুরতে আসা আফসানা জানান, ভীষণ সুন্দর একটি প্রদর্শনী। আমাদের দেশের প্রতিটা জিনিস এত সুন্দর মেলায় না এলে বুঝতেই পারতাম না। আশা করি আমাদের প্রচীন বাংলার ঐতিহ্যগুলো এভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।



মন্তব্য চালু নেই