যথেষ্ট নয় হিন্দুত্ববাদ, ভাঙছে ভারত-নেপাল বন্ধুত্ব

দিনে দিনে ভঙ্গুরতর হচ্ছে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও নেপালের বন্ধুত্ব। ভয়াবহ ভূমিকম্পে নেপালের প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় শুরুতেই ছোট্ট দেশটির প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল যে দেশ, মাত্র কয়েক মাস পরই সেই ভারতের সাথেই দ্রুত দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করেছে অপ্রত্যাশিতভাবে।

ভারতীয় দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কাঠমান্ডুতে গত বছরের অগাস্ট মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের এক বছর পেরোতে না পেরোতেই এবং প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পে ভারতের বন্ধুত্বের নিদর্শন সৃষ্টির কয়েক মাসের মাথায় যে গতিতে দেশ দু’টির কূটনৈতিক সম্পর্কে অবনতি ঘটছে- তা অপ্রত্যাশিত। এমনকি বর্তমানে হিন্দুত্ববাদও এই ভাঙন ঠেকাতে যথেষ্ট কারণ নয়। অনেকেই বলছেন ১৯৮৯ সালের অবরোধের পর এবারই প্রথম দেশ দু’টির মধ্যে সম্পর্ক সবচেয়ে করুণ আকার ধারণ করেছে।

সম্পর্কের এই অবনতির পেছনের মূল কারণ হলো নেপালের নতুন সংবিধান। ভারতের ধারণা, নেপালের এই সংবিধান মদেশিয়াদের জন্য প্রতিকূল।

নেপালের সমতল দক্ষিণাঞ্চলে তেরাইয়ের আদিবাসীরাই মদেশিয়া হিসেবে পরিচিত। ২০১১ সালে নেপালে পরিচালিত আদমশুমারি অনুযায়ী, নেপালের মোট ভূখণ্ডের ১৭ শতাংশ জুড়েই তেরাই অঞ্চল এবং সেখানে নেপালের ৫১ শতাংশ জনগণ বাস করে। নেপালের মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে তেরাইতে বসবাসরতদের ২২ শতাংশ মদেশিয়া এবং ২৯ শতাংশ মদেশিয়া নন- এমন জনগোষ্ঠী, যারা পাহাড়ি অঞ্চল থেকে তেরাইতে গিয়ে বসবাস করছেন।

নিজ দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছেন নেপালের মদেশিয়ারা।

ভারত ও নেপাল সীমান্তের মধ্যকার ‘নো-ম্যান’স ল্যান্ড’ এলাকার নিকটবর্তী দশগজায় মদেশিয়া আন্দোলনকারীদের অবরোধের কারণে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে বলে ক্ষুব্ধ নেপালি জনতা। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে নেপালি জনসাধারণ নিয়মিতই ভারতবিরোধী বিক্ষোভের আয়োজন করে এবং মোদির কুশপুত্তলিকা পোড়ায়। অথচ এই মোদিকেই আগে বীরোচিত মর্যাদায় ভূষিত করতেন এই নেপালি জনতাই।

আর এসব কারণে সবচেয়ে বিব্রত যে ব্যক্তিটি, তিনি হলেন নেপালের সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা। গতকাল শুক্রবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।

তার দল নেপালি কংগ্রেসকে সাম্যবাদীরা প্রায়ই উপহাস করে ‘ভারতের অনুচর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। গত বৃহস্পতিবার মোদির কুশপুত্তলিকা পোড়ানো এবং ভারতবিরোধী বিক্ষোভ থেকে বিরত থাকার জন্য নেপালিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন কৈরালা।

এর আগে ভারতে নিযুক্ত নেপালি রাষ্ট্রদূত দ্বীপ উপাধ্যায়ও ভারতের অবরোধের খবর প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে জনগণকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।

অনেকের ধারণা, ভারত-নেপাল সম্পর্কের সমস্যার উৎপত্তি জনকপুরের তেরাই শহরে মোদির সফরের ইচ্ছা থেকে। হিন্দু পুরাণ অনুসারে তেরাই হলো সীতার জন্মস্থান। এই তেরাইতে মোদি এমন এক সময় সফরের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন যখন নতুন সংবিধান অনুযায়ী নেপালের বিভিন্ন রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে তীব্র বিবাদ। আবার তেরাইতে মোদির সফর বাতিলের বিষয়টিকেও দেখা হচ্ছে মদেশিয়াদের প্রতি ভারতের সমর্থন হিসেবে।

নেপালের গণপরিষদে বক্তব্য রাখার সময় সফরকালীন মোদি ঐক্যভিত্তিক সংবিধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। পাহাড়ি নেপালী এবং মদেশিয়াদের মধ্যে দূরত্ব আরো বেড়ে যায় যখন নেপালী কংগ্রেস, কম্যুনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফাইড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট) এবং ইউনিফাইড কম্যুনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী) তেরাইকেন্দ্রিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই সংবিধান প্রণয়ন করল। সংবিধান প্রণয়নের আগেই সংসদ বর্জন করেছিল তেরাইয়ের দলগুলো।

তারপরেও নেপালের এই জাতীয় দল তিনটির মদেশিয়া প্রতিনিধিরা নতুন সংবিধানের পক্ষে ভোট দেয় এবং এর ফলে দেশটির রাষ্ট্রপতি, মদেশিয়া গোষ্ঠী আরেক প্রতিনিধি, রাম বরণ যাদব সংবিধান জারি করেন আনুষ্ঠানিকভাবে।

মদেশিয়াদের বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপকে পাহাড়ি নেতারা তখন ভালোভাবে নেননি। আর কম্যুনিস্ট পার্টি অব নেপালের নেতা কেপি ওলি দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদে সুশীল কৈরালাকে সফল হতে সাহায্য করেছিলেন, যা ভালোভাবে নেয়নি ভারত।

মাওবাদী চেয়ারম্যান পুষ্প কমল দহল তখন বলেছিলেন, ‘আমরা কারো কথায় সবসময় ‘হ্যাঁ’ বলার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারি না। এটা অদ্ভুত যে যেখানে সারা বিশ্ব আমাদের সংবিধানকে সমর্থন করছে, সেখানে প্রতিবেশী দেশেরই এতে সমর্থন নেই।’

নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ার পক্ষে কয়েকজন ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী নেতাদের মন্তব্যকে সুদৃষ্টিতে দেখেনি অসংখ্য নেপালি।

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র হিন্দু ভাবধারা সমর্থনের প্রবণতাকে বিবেচনায় রেখে অধিকাংশ নেপালী মনে করেছিলেন যে প্রতিবেশী দেশটির সাবেক ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপি নেপালের প্রতি অনেকটাই নমনীয় হবে।

বাণিজ্য ও ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে বিতর্কের জেরে ১৯৮৯ সালে ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার দুই দেশের মধ্যকার ২০ থেকে ২২টি প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়েছিল। নেপাল হয়ে চীন থেকে অস্ত্র আমদানির বিষয়ে ভারত আপত্তি জানালে ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সে সময় পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নেপালের রাজা বীরেন্দ্রকে সকালের নাশতার আমন্ত্রণ জানালে বীরেন্দ্র পররাষ্ট্র দপ্তর নির্ধারিত আচরণবিধির কারণ দেখিয়ে ওই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন।

কাকতালীয়ভাবে ভারতের সাবেক কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সরকারের আমলেও দুই দেশের মধ্যে সমস্যা দেখা গিয়েছিল।

১৯৯৯ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বীরেন্দ্রকে ভারতের তৎকালীন বিজেপি দলীয় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী সরকার আমন্ত্রণও জানিয়েছিল।

১৯৯৯ সালে বড়দিনের আগ মুহূর্তে কাঠমান্ডু থেকে কান্দাহারের পথে আইসি-৮১৪ ছিনতাই হয়ে গেলে তখনো দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। ওই ঘটনার কয়েক মাস পরই দিল্লিভিত্তিক একটি ইংরেজি পত্রিকা ‘নেপাল গেম প্ল্যান’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে হাতে পাওয়া নথিপত্রের ভিত্তিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে নেপালী রাজনীতিবিদ, উদ্যোক্তা ও অভিজাত সমাজের একজন মিত্রকে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

ওই ঘটনার পর দীর্ঘদিন ভারতের ওপর ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ছিল নেপাল।

২০০০ সালের শেষ নাগাদ বলিউড তারকা হৃত্বিক রোশন নেপালের বিষয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন বলে গুজব রটলে নেপালে ভারতবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়।

তাই সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, কেবল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি- এই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে ভারত ও নেপালের সম্পর্ক কখনোই তিক্ত হবে না, এরকমটা ভাবা হবে দু’ দেশের জন্যই বড় ধরনের ভুল।



মন্তব্য চালু নেই