যন্ত্রণার আরেক নাম হাইড্রোলিক হর্ন

রাস্তায় একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছেন, হঠাৎই গাড়ির হর্নের শব্দে পিলে চমকানোর অবস্থা। এমন পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক! তাহলে হর্নের শব্দে সড়কের পাশে বসবাসকারী মানুষের কী অবস্থা ভেবেছেন? আর এই যন্ত্রণার সবচেয়ে বড় যোগানদাতা বাস ও ট্রাকে ব্যবহৃত উচ্চমাত্রার হাইড্রোলিক হর্ন। অন্যগাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাত্রা বাড়িয়ে অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে এসেছে যা যেমনটা ক্ষতি করছে প্রাণিস্বাস্থ্য, তেমনি এর প্রভাব পড়ছে পরিবেশেও।

‘হে আল্লাহ হাইড্রোলিক হর্নের নির্যাতন থেকে মুক্তি চাই’- এটি পরিবেশ অধিদপ্তর বা পরিবেশবাদী কোনো সংস্থার প্রচারের ব্যানার নয়। শব্দ দূষণে অতিষ্ঠ মিরপুরের কালসী রোড এলাকায় বসবাসকারী মানুষের যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। মঙ্গলবার সকালে কালসী এলাকার অনেকেই বাস ও ট্রাকে ব্যবহৃত উচ্চমাত্রার হাইড্রোলিক হর্নের বিরক্তির কথা জানান। তারা বলছেন, এই হর্নের প্রচণ্ড শব্দের কারণে রাতে শান্তিতে ঘুমানো যায় না। আর দিনের বেলায় এর শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যায়।

শুধু কালসীই নয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতেও এর ব্যবহারে অতিষ্ঠ হচ্ছে মানুষ। শব্দদূষণে সৃষ্ট শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিরোধ করতে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করা হলেও যানবাহন মালিক, চালকরা তা মানছেন না। এই হর্নের উচ্চমাত্রার শব্দ মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, শিশুদের ও বয়স্কদের নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। পরিবেশ অধিদপ্তর ক্ষেত্রভেদে কোথায় শব্দের সীমা সর্বোচ্চ কত হবে তা নির্ধারণ করে দিলেও কেউই এটি মেনে মানছেন না।

নীরব এলাকার জন্য দিনে ৫০ ডেসিবল ও রাতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় ৫৫ ডেসিবল ও রাতে ৪৫ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবল শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু সংস্থাটি সম্প্রতি রাজধানীর ৬৬টি এলাকায় জরিপে চালিয়ে একটিতেও নিয়ন্ত্রিত মাত্রার শব্দসৃষ্ট এলাকা খুঁজে পায়নি।

জরিপ অনুযায়ী শব্দ দূষণপ্রবণ এলাকার শীর্ষে অবস্থান করছে যাত্রাবাড়ী। যেখানে শব্দের মাত্রা রয়েছে ৮৭.৬ ডেসিবল। ২০১৪ সালে তিন দফায় চালানো জরিপে সাত মসজিদ (কনফিডেন্স টাওয়ার) মোহাম্মদপুর এলাকায় ৬১.৪, পপুলার ডেন্টাল কেয়ারের সামনে ৭৬.৪ ডেসিবল, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি হাই স্কুলের সামনে ৬১.২ ডেসিবল, সিটি হাসপাতাল এলাকায় ৭১.৬ ডেসিবল, ফার্মগেট এলাকায় ৮৭ ডেসিবল, কাওরান বাজারে ৮৬ ডেসিবল, মতিঝিল শাপলা চত্ত্বরে ৮২ ডেসিবল, পল্টন মোড়ে ৭৫.২ ডেসিবল, শাহবাগ মোড়ে ৭১.৬ ডেসিবল, গাবতলীতে ৮০.২ ডেসিবল, মহাখালী বাসষ্ট্যাণ্ড এলাকায় ৭৭.৩ ডেসিবল, বিজয় সরণি ও জিয়া উদ্যান এলাকায় ৭৭ ডেসিবল, টেকনিক্যাল মোড়ে ৭৭ ডেসিবল, শ্যামলী শিশুমেলা এলাকায় ৭৬.২ ডেসিবল শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে।

এছাড়াও ২০১৫ সালের মার্চে একই সংস্থার অপর এক জরিপে আগারগাঁও মোড়ে ৬৮.৫ ডেসিবল, জিয়া উদ্যান এলাকায় ৬৯.৫ ডেসিবল, বিজয় সরণি ৭৩.৫ ডেসিবল, ফার্মগেটে ৭৬.৫ ডেসিবল, পুরানা পল্টনে ৭৫.২ ডেসিবল, সিটি হাসপাতাল এলাকায় ৭১.৬, মানিক মিয়া এভিনিউয়ে (পূর্ব) ৬৯.৬ ডেসিবল, শ্যামলী বাসস্ট্যাণ্ডে ৭৭.২ ডেসিবল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এলাকায় ৭২.১ ডেসিবল, মানিক মিয়া এভিনিউ (দক্ষিণ) ৬৮.৫ ডেসিবল, আসাদ গেট এলাকায় ৭০ ডেসিবল, কলেজ গেট ৭২ ডেসিবল, শিশুমেলায় ৭৬.২ ডেসিবল, কল্যাণপুর বাসস্ট্যাণ্ড ৭১.২ ডেসিবল, টেকনিক্যাল মোড়ে ৭৫.৩ ডেসিবল, গাবতলী এলাকায় ৮০.২ ডেসিবল শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৮৫ ডেসিবলের বেশি মাত্রার শব্দ সৃষ্ট এলাকায় ৮ ঘণ্টা সময় অবস্থান করলে মানুষের শ্রবণশক্তি লোপ পায়। আর ১১০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ দূষণ মাত্র দেড় মিনিট অবস্থান করলেও একই পরিণতি হয়। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ৬০ ডেসিবল শব্দে মানুষের শ্রবণশক্তি সাময়িকভাবে এবং ১০০০ ডেসিবল শব্দে শ্রবণশক্তি চিরতরে হারাতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নাক, কান, গলা বিভাগের অডিওলজি শাখায় পাঁচ বছর আগে ৮ শতাংশ রোগীর বধিরতার কারণ হিসেবে শব্দ দূষণকেই দায়ী করা হতো। যেটা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৬ শতাংশ। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এর মাত্রা আরো বেশি। তারা সামান্য দূষণেই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে দিন দিন এর সংখ্যা আরো বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর আলমগীর চৌধুরী  বলেন, শব্দ দূষণ মানবদেহ এবং মস্তিষ্কে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে । অতিরিক্ত শব্দ শোনার কারণে একজন ব্যক্তির কানে ব্যথা, কানের ভেতর ঝিমঝিম করা, মাথা ব্যথা, দুশ্চিন্তা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, বদহজম, পেপটিক আলসার, ঘুমের ব্যঘাতসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। অতিরিক্ত শব্দ শুনলে বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পাশাপাশি ব্রেন টিউমারের মতো রোগও হতে পারে। তিনি জানান, রাজধানীতে এ জাতীয় রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ট্রাফিক পুলিশ, বাস-ট্রাক, লেগুনা, সিএনজির ড্রাইভার, হেলপার, কন্টাকটর ও ফুটপাতের ব্যবসায়িরা।

ট্রাফিক পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আনিসুর রহমান আনিস বলেন, ‘কাজ শেষ করে বাসায় গেলে টিভি দেখার সময় ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে খবর শুনতে হয়। অল্প কথায় মেজাজ চড়ে যায়।’ যারা এ পেশায় ২০ বছরের বেশি দিন আছেন তাদের মাথা ও কান ব্যথা করে বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজধানীতে শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন। ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও এর ব্যবহার এখনো বন্ধ হচ্ছে না। রাজধানীর স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসহ বিভিন্ন এলাকায় উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো নিষেধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপে রাজধানীতে শব্দ দূষণের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- মাইক, লাউড স্পিকার, ইট ও পাথর ভাঙার মেশিন, জেনারেটর, শিল্পকারখানা, কনস্ট্রাকশন, দালান ভাঙার কাজ ইত্যাদি।বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই