যা করি সবই করছে জ্বিন, বলেই নারীর গোপনাঙ্গে হাত

মহিউদ্দিন অদুল: তিন জিন। একজন বৃদ্ধ। ৭০০ থেকে ৮০০ বছর বয়সী ‘জিন’। তার নাম মোল্লা ভাই। অপর দু’জন নারী ‘জিন’। অবিবাহিতা তরুণী সহোদর। উচ্চ শিক্ষিতা। একজন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। ফাতেমা ও মাহিয়া মাহী। এই তিন ‘জিন’ আবুল কালাম আজাদ খন্দকারের (৪২) বশ মানানো। তার ওপর ভর করা। তাদের দিয়েই চলে আসছিল এই স্বঘোষিত ভণ্ডপীরের চিকিৎসা।

জিন হাজির। তন্ত্র-মন্ত্র। কিংবা অসাধ্য সাধন। তার প্রধান টার্গেট অসুস্থ বা সমস্যাগ্রস্ত ধনাঢ্য সহজ-সরল নারী। বহু শিকারই লন্ডন প্রবাসী। তারা তার কথিত এই জিনের ফাঁদে হারিয়েছে কোটি টাকা। হারিয়েছে সম্ভ্রম। তার জন্য পাগল হয়ে বিয়ে করতে যুক্তরাজ্য থেকে ছুটে এসেছে বৃদ্ধা অন্ধ নারী ভক্ত। সে নিজ কণ্ঠ নকল ও বিকৃত করেই জিনের নামে কথা বলতো। ব্যবহার করতো অন্যদের কণ্ঠও। জিন হাজিরার আসরে এক ভুক্তভোগীর কাছে ধরা পড়ে বিষয়টি। মুখ ঘুরিয়ে নারী কণ্ঠ নকল করতেই তিনি ধরে ফেলেন ভণ্ডপীরের ভণ্ডামি। এর জের ধরে অবশেষে সে এখন কারাগারে।

গত ৭ই জানুয়ারি রাজধানীর খিলক্ষেত থানাধীন নিকুঞ্জ-২ এর ১৩ নম্বর রোডের এক ভক্তের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নিজের পাতা ভয়াবহ জিনের ফাঁদের কথা স্বীকার করে সে। তবে তার সহযোগী ও একাধিক অন্ধ ভক্ত জামিন নিতে মরিয়া।

তার তেমনই এক শিকার আফিয়া বেগম (ছদ্মনাম)। ৫৫ বছর বয়সী এই নারী যুক্তরাজ্য প্রবাসী। সে দেশের নাগরিকও। থাকেন লন্ডন সিটিতে। কয়েক বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামী মারা যান। সে গাড়িতে তখন তিনিও ছিলেন। ওই দুর্ঘটনার পর থেকে তার কিছুটা মানসিক অস্থিরতা ছিল। একই সঙ্গে অহেতুক অসুস্থতা বোধের মধ্য দিয়ে দিন কাটছিল তার। কিন্তু সে দেশের চিকিৎসকরা আফিয়া পুরো সুস্থ বলেই জানান বার বার।

২০১২ সালে একমাত্র উচ্চ শিক্ষিত কন্যা সাবিহা রহমানের (ছদ্মনাম) বিয়ে দিতে তাকে নিয়ে দেশে আসেন। নিকুঞ্জের ওই বাসায় ভাড়ায় উঠেন। সেখানে অন্য এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ওই ভণ্ডপীরের চিকিৎসা নিতে শুরু করেন ওই বয়স্ক নারী। এরপর মেয়ের বিয়ে হয়। সেখানে একদিন চিকিৎসার জন্য জিন হাজিরের কথা বলে আসর বসায় আবুল কালাম আজাদ। ওই জলসায় নারী জিনের কণ্ঠ নকল করার বিষয়টি মেয়ে সাবিহার কাছে ধরা পড়ে।

সঙ্গে সঙ্গে তাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেন তিনি। কিন্তু ভক্ত মা নাছোড়বান্দা। অন্ধ বিশ্বাসে মশগুল। তাকে জিনের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলিয়ে দেয়ার নামে দেশে ও লন্ডনে অবস্থানকালে দফায় দফায় আদায় করতে থাকে বড় অঙ্কের টাকা। ২, ৫ ও ১০ লাখ টাকা করে আদায় করে। এছাড়া সম্প্রতি এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এফডিআর ভাঙিয়ে লভ্যাংশসহ ৩০ লাখ টাকা তার হাতে তুলে দেয়ার কথা জানিয়েছেন ওই নারীর জামাতা। ওই নারীর কাছ থেকে আদায় করে একটি প্রাইভেট কারও। ভণ্ডপীরের প্রভাব থেকে মাকে মুক্ত করার চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়। মেয়ের সে চেষ্টায় কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য।

আপন মা-ই আবুল কালামের কথা মতো নিজের গর্ভবতী মেয়েকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার অপচেষ্টায় নামে। তার দেয়া বিষাক্ত ওষুধ ও মাদক গোপনে মেয়ের খাবারে মিশিয়ে খাওয়াতে শুরু করে। এসব ঘটনার একপর্যায়ে অনুসন্ধানে নামে মেয়ের স্বামী। তার বসানো গোপন ক্যামেরায় তা ধরাও পড়ে।

সর্বশেষ গত ৬ই জানুয়ারি ওই বৃদ্ধা ভণ্ডপীরকে বিয়ের জন্য দেশে চলে আসেন। এর পরদিন গোপনে দেশে আসেন তার মেয়ের স্বামী। তিনি পুলিশকে জানালে গত ৭ই জানুয়ারি নিকুঞ্জের ওই বাসা থেকে আবুল কালামকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে আসে ফাঁদের চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।

তার প্রতারণার আরেক শিকার লন্ডন প্রবাসী ছালেহা খাতুন। ছেলের বউয়ের সঙ্গে তার মিলমিশ হচ্ছিল না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আফিয়াই লন্ডন প্রবাসী সালেহা খাতুনকে ওই পীরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এই পীর তার বশ করা জিন ফাতেমা ও মাহিয়া মাহীর সঙ্গে আফিয়ার মতোই মোবাইলে কথা বলিয়ে দেয়। ‘জিনেরা’ মোবাইলে বলে, ‘লন্ডনের বাসার চারদিকে মাটিতে তাবিজ পোঁতা আছে। সে তাবিজ তুলতে হবে। যেতে হবে যুক্তরাজ্যে। এক বোন যুক্তরাজ্যে পড়ে। সেখানকার সব কিছু চেনাজানা। সে পোল্যান্ড হয়ে যাবে যুক্তরাজ্যে। লাগবে প্লেন ভাড়া ও অন্যান্য খরচ।’ এছাড়া উপঢৌকন হিসেবেও দু’লন্ডন প্রবাসীর কাছ থেকে আদায় করে লাখ লাখ টাকা। সেই আলাপচারিতায় জিন ফাতেমা বলে, ‘আমার ছোট বোন মাহিয়া মাহীকে আগে বিয়ে দেবো। তার বিয়ের জন্য ৩০০ থেকে ৪০০ ফুট লম্বা স্বর্ণের খাট দিতে হবে। দিতে হবে একই দৈর্ঘ্যের স্বর্ণের চেনও। লাগবে বহু টাকা।’ এসব কথা সরল বিশ্বাসে মেনে নেয় ওই দু’নারী। তার হাতে তুলে দেয় লাখ লাখ টাকা। ছালেহা খাতুন দফায় দফায় ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় ১১ লাখ টাকা।

আরেক ভুক্তভোগী ঢাকা মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের এক ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মধ্যবয়সী রহিমা খাতুন অস্থির ছিলেন নিজের বিবাহিত মেয়ের সমস্যা নিয়ে। মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে পছন্দ করতো না। নির্যাতন করতো। সেও ওই সমস্যার সমাধানের উপায় খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার এই জিন কবিরাজের সন্ধান পান। ওই জিন কবিরাজ জিনের মাধ্যমে চিকিৎসার জন্য তার কাছ থেকে ২০১৫ সালের ২৬শে আগস্ট হাতিয়ে নেয় ১ লাখ ১ হাজার টাকা। কিছুদিন পর আরো ৫০ হাজার টাকা। পরের মাসের ২৪ তারিখ নেয় আরো ২ লাখ টাকা। কিন্তু জিনের চিকিৎসায় কোনো কাজ হয়নি। অবশেষে সংসার ভাঙে মেয়ের। কাজ না হওয়ায় টাকা ফেরত চান তিনি। তখন সে বলে জিনের কৈফিয়ত আদায় এবং জিনের মাধ্যমে কাজ আদায় করিয়ে নেয়ার জন্য খালি বাসায় জিন হাজিরা বসাতে হবে। আগর ও মোমবাতিসহ বসাতে হবে জিন হাজিরার আসর।

বাসায় রহিমা ও আবুল কালাম ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবে না। সেই আয়োজনও হলো। একপর্যায়ে সে বললো, ‘আমার ওপর এখন জিন ভর করেছে। আমি যাই করি তার সবই করছে জিনই। খারাপ কিছু মনে করা যাবে না। রহিমাকে সব মেনে নিতে বলে। এরপর সে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধর্ষণে উদ্ধত হয়। ধস্তাধস্তিতে ছিঁড়ে ফেলে পরনের কাপড়। ওই নারী বাথরুমে ঢুকে হুক লাগিয়ে সম্ভ্রম রক্ষা করেন।’ পরে সে ডাকাডাকি শুরু করে দিলে দ্রুত পালিয়ে যায় আবুল কালাম। এই ঘটনার পরই গত ২১শে জানুয়ারি তাকে আসামি করে ৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন।

ভুক্তভোগী রহিমা বলেন, সে জিনের নামে আমার স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিলে আমি তার ভণ্ডামি বুঝতে পারি। তারপর কোনোমতে বাথরুমে ঢুকে নিজেকে রক্ষা করি। অথচ দীর্ঘদিন তার কথায় মজে গিয়েছিলাম। রহিমা তার এই ভণ্ডামি থেকে আত্মরক্ষা করতে পারলেও ব্রাক্ষণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বহু নারী নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। টাকা ও স্বর্ণালংকারের সঙ্গে হারিয়েছেন সম্ভ্রমও। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার একটি বাড়িতে কয়েক বছর আগে সে একই অবস্থায় ধরা পড়ে। পরে গ্রামবাসীর কাছে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পাওয়ার পর উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। এরপর গ্রামবাসীরাও তার সহযোগীদের কাছ থেকে দূরে থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবুল কালাম আজাদের বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া সদরের শ্রীরামপুর গ্রামে। তার পিতার নাম মন মিয়া। তার দু’স্ত্রী। অক্ষরজ্ঞানহীন আবুল কালাম দীর্ঘদিন এই প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বিয়ের আগে থেকেই সে জিনের ফাঁদ পেতে মানুষের সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছিল। তার অন্য কোনো আয়ের উৎসও নেই। সে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দয়াল বাবা গণি শাহ নামে এক মাজারের কামেল পীর বলে নিজেকে পরিচয় দিয়ে আসছিল। তার এ পরিচয়ের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টাও করে। বিদেশ থেকে ফোন করার নামে ওই মাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিজেকে ওই পীরের মুরিদ বলে দাবি করে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা গণি শাহর ভক্ত ছাড়া কোনো মুরিদ থাকার কথা জানা নেই বলে জানালে সে আর তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেনি। তবে ওই মাজারের কামেল পীর বলে বিভিন্ন জায়গায় পরিচয় দিয়ে জিনের ফাঁদ পেতে মানুষের সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছিল। ঢাকা ও ব্রাক্ষণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় আরো বহু লোক তার জিনের ফাঁদে সর্বস্ব হারিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

লন্ডন প্রবাসী আফিয়ার মেয়ের জামাই বলেন, ওই ভণ্ডপীর জিনের কথা বলে সহজ-সরল নারীদের ভুলিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে আসছিল। আমার স্ত্রী প্রথমেই বিষয়টি বুঝতে পারলেও আমার স্বল্প শিক্ষিত শাশুড়িকে বিরত রাখা যায়নি। তিনি লাখ লাখ টাকা তাকে দেয়ার পরও ৭০ লাখ টাকার এফডিআর ভেঙে শেষে লাভসহ ৩০ লাখ টাকা তার হাতে তুলে দিয়েছেন। গোপন ক্যামেরায় ও মোবাইলের রেকর্ডে তার ভণ্ডামি ধরা পড়ার পর অবশেষে তাকে আটক করা সম্ভব হয়েছে। আদালতে জবানবন্দিতেও তা স্বীকার করেছে। তিনি বলেন, আর কাউকে যেন এমন ভণ্ডপীরের কাছে সর্বস্ব হারাতে না হয়। #মানবজমিন



মন্তব্য চালু নেই