যেভাবে এই ধনকুবের মীর কাসেমের উত্থান

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্রগ্রাম অঞ্চলে ‘খান সাহেব ওরফে বাঙাল খান’ নামে পরিচিত ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধী মীর কাসেম আলী।

জামায়াত নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছেন মীর কাসেম আলী ওরফে খান সাহেব। জামায়াতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী একজন বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী। জামায়াত-শিবিরের অর্থের প্রধান জোগানদাতাও তাকেই বলা হয়।

নামে-বেনামে শতশত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক এই জামায়াত নেতা। মূলত অর্থবিত্তের কারণেই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে রয়েছে তার ব্যাপক প্রভাব।

মীর কাসেম আলীর বেড়ে ওঠা : মীর কাসেম আলীর জন্ম ১৯৫২ সালে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে। তার বাবা তৈয়ব আলী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। মীর কাসেমকে এলাকার মানুষ মিন্টু নামেই চেনেন। বাবার চাকরির সুবাদে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন চট্টগ্রামে। ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের ছাত্র থাকাকালে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি হন তিনি।

একাত্তরের ভূমিকা : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জামায়াত পক্ষ নেয় পাকিস্তানের। রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারির পর জামায়াতে ইসলামী তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রসংঘের নেতাদের নিজ নিজ জেলার আলবদর বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেন। সেই সুবাদে মীর কাসেম আলী চট্টগ্রাম জেলার প্রধান হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে তার নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী সমাবেশ আয়োজন করা হয়। সভাপতি হিসেবে তিনি তার ভাষণে বলেন, গ্রামগঞ্জে প্রতিটি এলাকায় খুঁজে খুঁজে পাকিস্তানবিরোধীদের শেষ চিহ্নটি মুছে ফেলতে হবে।

মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ হচ্ছে- তিনি সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়ি ‘মহামায়া ভবন’ দখল করে বানান টর্চার সেল। ডালিম হোটেল নামে পরিচিত ওই টর্চার সেলে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হতো।

স্বাধীন দেশে মীর কাসেম আলী : জানা যায়, স্বাধীনতার পর মীর কাসেম ঢাকায় আসেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে-না-যেতেই মুক্তিযোদ্ধাদের রোষানলে পড়ার ভয়ে চলে যান লন্ডনে। সেখান থেকে সৌদি আরব। সৌদিতে থাকাকালীন সেখানকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তার সুসম্পর্ক হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে ফিরে আসেন মীর কাসেম।

মীর কাসেমের নেতৃত্বেই ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ছাত্রসংঘ নাম পরিবর্তন করে ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে। তিনি হন শিবিরের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি। এরপর মীর কাসেমকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে ১৯৮০ সালে তিনি রাবেতা আল ইসলামীর এ দেশীয় পরিচালক হন।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর টাকায় আস্তে আস্তে গড়ে তোলেন ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস। জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের আয় ও কর্মসংস্থানের বড় উৎস হয়ে দাঁড়ায় এসব প্রতিষ্ঠান। সঙ্গে সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে বাড়তে থাকে তার আধিপত্য।

যত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক মীর কাসেম : মীর কাসেম আলী দলীয় আর্থিক ফান্ড সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি নিজেও হয়েছেন শত শত কোটির টাকার মালিক। ব্যাংক, চিকিৎসাসেবা, পরিবহণ, টেলিযোগাযোগ, গণমাধ্যম ও শিক্ষা সব খাতেই রয়েছে তার দাপুটে বিচরণ ।

মীর কাসেম আলী মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রাবেতা আল ইসলামীর বাংলাদেশ পরিচালক, ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ইবনে সিনা ট্রাস্ট (প্রশাসন) ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের বোর্ড অব ডিরেক্টরের সদস্যও তিনি।

এই ট্রাস্টের আটটি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ও ইমেজিং সেন্টার, একটি মেডিক্যাল কলেজ, একটি নার্সিং কলেজ ও একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক স্কুল ও কলেজ এবং দিগন্ত পেপার মিলের মালিক কাসেম আলী। তিনি ফুয়াদ আল খতিব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট (এআইটি) ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।

দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলী। এর অধীনে রয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকা আর দিগন্ত টেলিভিশন।

এ ছাড়া মীর কাসেম আলীর ব্যক্তিগত বাণিজিক গ্রুপের নাম ‘কেয়ারী’। তিনি কেয়ারী হাউজিং ও ইডেন শিপিং লাইনসের চেয়ারম্যান। নামের আগে ‘কেয়ারী’ রয়েছে এ রকম ১০টি কোম্পানির পরিচালক মীর কাসেম আলী। এগুলো হলো- কেয়ারী লিমিটেড, কেয়ারী পোলট্রি হ্যাচারি অ্যান্ড প্রসেস, কেয়ারী স্প্রিং, কেয়ারী শান, কেয়ারী ট্যুরস অ্যান্ড সার্ভিসেস, কেয়ারী তাজ, কেয়ারী কালার সেন্টার, কেয়ারী ঝরনা, কেয়ারী রিয়েল অ্যাস্টেট ও কেয়ারী টেলিকম লিমিটেড।

কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার জন্য রয়েছে মীর কাসেমের একক মালিকানাধীন বিলাসবহুল পাঁচটি প্রমোদতরি কেয়ারী ক্রুইজ, কেয়ারী ডাইন, কেয়ারী সিন্দবাদ, কেয়ারী কর্ণফুলী ও কেয়ারী তরঙ্গ।

এ ছাড়া কেয়ারী গ্রুপের সহস্রাধিক অ্যাপার্টমেন্ট ও বিপণি বিতান রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে।

বিচার ঠেকাতে মীর কাসেমের তৎপরতা : জানা যায়, মানবতাবিরোধী বিচারের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে মীর কাসেম আলী ২০১০ সালের ১০মে ছয় মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কনসালট্যান্সি ফার্ম কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে চুক্তি করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ ও লবিং করাই ওই চুক্তির লক্ষ্য।

চুক্তি অনুযায়ী কনসালট্যান্সি ফার্মটি মীর কাসেম আলীর পক্ষে আমেরিকান কংগ্রেস, সিনেট সদস্য এবং ইউএস প্রশাসনের প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করবে। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বৈদেশিক নীতির বিষয়ে মতামত দেবে।

তারই লবিংয়ে হাউস অব কমন্সের শক্তিশালী একটি লবিস্ট গ্রুপ কাজ শুরু করে এবং তারা যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে থাকে।

মীর কাসেম আলীর ভাই মীর মাসুম আলী ও জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাকীবুর রহমান নিজামীর তত্ত্বাবধানে ‘অর্গানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’ এবং হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ চালাতে শুরু করে নানা প্রচারণা। ‘ক্লোয়াক্রম অ্যাডভাইজর’ ও ‘কে গ্লোবাল’ নামে দুটি লবিং প্রতিষ্ঠানও সাবকনট্রাক্টের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে তাদের সঙ্গে।

বিচারের মুখোমুখি : এত কিছু করেও শেষ রক্ষা পাননি জামায়াতের প্রভাবশালী এই ব্যবসায়ী নেতা। জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।

ওই দিন বিকেলেই মতিঝিলে দৈনিক নয়া দিগন্ত কার্যালয়ের (দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন) থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ দাখিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। ২৬ মে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১। এরপর মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর মীর কাসেম আলীকে ১৪টি ঘটনায় অভিযুক্ত করে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।

বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা জসিম ও জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে হত্যার দায়ে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এর মধ্যে ১২ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে রায় প্রদান করা হয়।

২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড থেকে বেকসুর খালাস চেয়ে আপিল করেন মীর কাসেমের আইনজীবীরা। আপিলে তার খালাসের পক্ষে ১৮১টি যুক্তি তুলে ধরা হয়।
চলতি বছরের গত ৮ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ ৬ জনকে নির্যাতন করে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

অবশেষে মৃত্যদণ্ড কার্যকর : মীর কাসেমের ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে ২৪৪ পৃষ্টার আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় গত ৬ জুন প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

নিয়মানুযায়ী, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গত ১৯ জুন ফাঁসির দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন দাখিল করেন মীর কাসেম আলী। মোট ৮৬ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ১৪ টি যুক্তি দেখিয়ে ফাঁসির দণ্ড থেকে খালাস চাওয়া হয়।

গত ২৮ আগস্ট মীর কাসেমের রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষ হয়। মীর কাসেমের পক্ষে রিভিউ শুনানিতে অংশ নেন তার প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।
৩০ আগস্ট সকালে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। রিভিউ খারিজ হওয়ায় মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আইনগত বাধা কেটে যায়। এরপর থাকে শুধু প্রাণভিক্ষা।

২ আগস্ট জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী কারা-কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। প্রাণভিক্ষার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে ফাঁসি কার্য্করের উদ্যোগ নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। সে মোতাবেক মীর কাসেমের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের শেষ সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়।

অবশেষে সরকারের নির্বাহী আদেশে ৩ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকরের মধ্যে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।



মন্তব্য চালু নেই