যেভাবে ফেসবুকে অর্থ হাতিয়ে নিলেন প্রতারকরা

র‌্যাবের হাতে আটক প্রতারকরা ফেসবুকে পরিচয়, অন্তরঙ্গতা ও বন্ধুত্ব, এরপরই শুরু প্রতারণা। ইউরোপীয় দেশের বন্ধুর কাছ থেকে উপহার সামগ্রী পাঠানোর নামে বিভিন্ন ছলে ও কৌশলে টার্গেট ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। তাদেরই একটি চক্রের পাঁচ দেশি-বিদেশি সদস্যকে আটকের পর প্রতারণার বিভিন্ন কৌশলের তথ্য জানতে পারে র‌্যাব।

গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় গ্রেফতার হওয়া প্রতারক চক্রের সদস্যরা র‌্যাবকে জানান, আগে তারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল তরুণ-তরুণীকে অভিনব পন্থায় প্রেমের ফাঁদে ফেলে টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করতেন। এ বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় তারা এই কৌশল বদল করে।

বাংলাদেশি দুই প্রতারক মোহাম্মদ আলী ও মঞ্জুর মাহমুদ র‌্যাবকে জানান, নাইজেরিয়ান নাগরিকরা ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট থেকে তাদের সঙ্গে যৌথভাবে গার্মেন্ট ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি প্রতারণার মাধ্যমে পাওয়া টাকা মোহাম্মদ আলী ৫ ভাগ এবং মঞ্জুর মাহমুদ ৫ ভাগ কমিশন পেতেন। প্রতারণার প্রথম পর্যায়ে তারা বাংলাদেশিদের মাধ্যমে টার্গেট খুঁজতে থাকে। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে টার্গেট প্রাপ্তি সাপেক্ষে তাদের ফেসবুক আইডি বের করে তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়। এসব ক্ষেত্রে তারা খুবই সুদর্শন এবং আমেরিকা অথবা ইউরোপের নাগরিক পরিচয় দেন। তাদের এ প্রতারণার ক্ষেত্রে কিছু মহিলা সদস্যও রয়েছেন। বন্ধুত্ব গাঢ় হওয়ার পরে তারা প্রেমের অভিনয় এবং বিভিন্ন উপহার প্রেরণের মাধ্যমে সম্পর্কটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তারা।

র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল তরুণ-তরুণীকে অভিনব পন্থায় প্রেমের ফাঁদে ফেলে অর্থ আত্মসাৎ করা একটি পুরাতন প্রক্রিয়া। সম্প্রতি এ ধরনের অসাধু চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু বিদেশি নাগরিক যারা বিষয়টিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

এসব কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে তারা মূলত স্বচ্ছল ব্যক্তিদেরকে টার্গেট করেন যারা নিজেরাই টাকা প্রদান করতে সক্ষম। তেমনি এক ঘটনায় অপরাধীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কর্মরত একজন চিকিৎসকের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় ও সখ্যতা গড়ে তোলেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশিরা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তারা জাল ডলারের ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, অবৈধ ভিওআইপির ব্যবসা ও নিত্য নতুন প্রতারণার মতো অপরাধ করে যাচ্ছে।

সম্প্রতি ফেসবুকের মাধ্যমে ডেসমন্ড বি স্যামুয়েল নামের এক ব্রিটিশ নাগরিকের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওই নারী চিকিৎসকের বন্ধুত্ব হয়। সঙ্গে হোয়াটস অ্যাপ-এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ ব্রিটিশ ভাষায় বিভিন্ন সময় তাদের কথা হয়। বন্ধুত্বের সূত্রে ডেসমন্ড বি স্যামুয়েল তাকে ইংল্যান্ড থেকে কিছু উপহার সামগ্রী পাঠিয়েছেন বলে জানান।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি মিন-রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি কুরিয়ার সার্ভিসের একজন প্রতিনিধি সম্পূর্ণ বৃটিশ ভাষায় ওই নারী চিকিৎসককে জানান, তার নামে ইংল্যান্ড থেকে একটি গিফট বক্স এসেছে। এতে পরিবহন ব্যয় বাবদ ৫৬ হাজার ৫৬৬ টাকা টাকা পরিশোধ করতে হবে। সেই মোতাবেক ওই চিকিৎসক গত ১১ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মিন-রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের সোনালী ব্যাংকের উত্তরা শাখার অ্যাকাউন্টে (হিসাব নং-০০১০১৭৮০৯) ওই টাকা পরিশোধ করেন।

কমান্ডার মুফতি মাহমুদ জানান, ওই টাকা জমা দেওয়ার পর ১৩ ফেব্রুয়ারি মিন-রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের একই প্রতিনিধি একই মোবাইল ফোন নম্বর থেকে চিকিৎসককে ফোন করে বলেন, ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো গিফট বক্স স্ক্যানিংয়ের পর দেখা যায় সেখানে ডায়মন্ডের (হিরক) মূল্যবান গহনা আছে। যার আনুমানিক মূল্য হবে ২ কোটি টাকা। তাই এই গিফট বক্স সংগ্রহ করতে হলে তাকে ২ লাখ ৬২ হাজার ৯০০ টাকা আরেকটি ব্যাংক হিসাব নম্বরে পাঠাতে হবে।

ওই প্রতিনিধির কথা অনুযায়ী গত ১৪ ফেব্রুয়ারি এসএমএস-এর মাধ্যমে পাঠানো মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের উত্তরা শাখার ০৬৪১০২১০০০০৯৮৬ নম্বর অ্যাকাউন্টে আবার ২ লাখ ৬২ হাজার ৯০০ টাকা জমা করেন। একইদিন বিকালে তাকে জানানো হয় বক্সের ভেতরে অনেক মূল্যবান জিনিস থাকায় আরও ১০ লাখ ৮৩ হাজার টাকা পাঠাতে হবে। তখন বিষয়টি চিকিৎসকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।

পরে তিনি র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করেন। এরপর র‌্যাব-২ এর গোয়েন্দারা প্রতারক চক্রের সন্ধানে নামেন। তাদের একটি আভিযানিক দল বিভিন্ন কৌশলে ব্যাংক হিসাবের ২ মালিক মোহাম্মদ আলী (৩০) ও মঞ্জুর মাহমুদকে (৩১) আটক করেন। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ফেসবুক, টুইটার, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ এবং ইমো-এর আইডি বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের তিন সদস্যের সন্ধান পান।

এরপরই তারা রাজধানীর নিকেতনের এক নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে নাইজেরিয়ান নাগরিক ফ্র্যাংকিন (৩০), ওভি হিচে (৩৪) ও আইকে ফ্লেস্ককে (৩৫) আটক করেন। তাদের কাছে বাংলাদেশে থাকার কোনও বৈধ কাগজপত্রও নেই। এসময় তাদের কাছ থেকে ৫৩ হাজার টাকা, পাসপোর্ট, বিভিন্ন ব্যাংকের ব্লাংক চেক, ক্রেডিট কার্ড এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য বেশ কিছু অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলফোন উদ্ধার করা হয়।-বাংলাট্রিবিউন



মন্তব্য চালু নেই