যেভাবে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এমপি বদি

শাসকদলীয় এমপি বদির একটি জগৎ রয়েছে। যা প্রকাশ্য নয়। অন্ধকার জগৎ। বাংলাদেশের ইয়াবা ব্যবসার সর্বোচ্চ গডফাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেই জগতের এই মুকুটহীন সম্রাট। তার ভয়ঙ্কর ছোবলে বাংলাদেশের দক্ষিণের শেষ প্রান্তের সাগর-পাহাড়-বনভূমিঘেরা টেকনাফ এখন বিষে জর্জরিত। সুন্দর এই জনপদটি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের অবাধ বিচরণ ভূমি।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তাকে আরও তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বুধবার বেলা সোয়া ১১টায় ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার এ রায় ঘোষণা করেন।

কে এই বদি এবং কিভাবে তিনি অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন?

আবদুর রহমান বদি। টেকনাফ ও উখিয়া নিয়ে গঠিত কক্সবাজার-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি তিনি। সরকারি সুযোগ-সুবিধায় দাপিয়ে বেড়ান দেশ-বিদেশে।

দক্ষিণ এশিয়ার মাদক সাম্রাজ্যে এমপি বদি ‘মেজভাই’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন অনেক আগেই। চোরাচালান, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অনিয়ম, দখল, ক্ষমতার দাপটের নজিরবিহীন সব কাণ্ড তার অন্ধকার জগৎকে সমৃদ্ধি করেছে। এমপি বদি এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন যে, তার কথা মতো কাজ না করায় তিনি নিজেই মারধর করেছেন সরকারি কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক, আইনজীবী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ অনেককেই। মাদক ও চোরাচালান করতে এমপি বদি নজিরবিহীনভাবে ব্যক্তিগত বন্দর ও ঘাট পর্যন্ত গড়ে তোলেন। এমপি বদির পরিবার এখন নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের ইয়াবা ব্যবসা।

বদির উত্থান: অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত অথবা আওয়ামী লীগ; যে আমলেই হোক, যেভাবেই হোক সংসদ সদস্য হতে চেয়েছিলেন আবদুর রহমান বদি। বিএনপির কাছে মনোনয়ন চেয়েছিলেনও। তবে আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়েই পার হয়েছেন বৈতরণী। এরশাদ সরকারের সময় বদির বাবা এজাহার মিয়া ছিলেন টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান। বাবার কাছেই রাজনীতির হাতেখড়ি সমালোচিত এই এমপির। এরশাদ সরকারের পর বদির বাবা যোগ দেন বিএনপিতে। টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বাবার হাত ধরেই টেকনাফ উপজেলা বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে শুরু করেন তিনি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বিএনপি আমলে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে বিভিন্ন চোরাচালানি ব্যবসায় হাত পাকান বদি। তবে ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তেই বিএনপি থেকে মনোনয়ন চেয়ে বসেন তিনি। কিন্তু অপকর্মের খবর পাওয়ায় সে সময় বিএনপির হাইকমান্ড বদিকে মনোনয়ন দেয়নি বলেও শোনা যায়। পরে রাতারাতি নিজেকে পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দেন বদি। সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ ও ১৯৯৬ সাল ছাড়া পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে জিততে পারেনি আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে জয় ছিনিয়ে আনেন বদি। টেকনাফে শুরু হয় বদির শাসন। হয়ে ওঠেন অন্ধকার জগতের মুকুটহীন সম্রাট।

সবার বড় বদি : আন্তর্জাতিক চোরাচালান সিন্ডিকেটের অন্যতম গডফাদার ছিলেন টেকনাফের এজাহার মিয়া ওরফে এজাহার কোম্পানি। নিরাপত্তা বাহিনীর তালিকাভুক্ত এই শীর্ষ চোরাচালানির ১২ জন স্ত্রীর ২৬ সন্তানের মধ্যে সবার বড় আবদুর রহমান বদি। জানা যায়, বাবার বিশাল চোরাই ব্যবসায় কিশোর বয়সেই হাতেখড়ি হয় তার। বঙ্গোপসাগর দিয়ে অস্ত্র, মাদকসহ নানা চোরাই পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের টানেলখ্যাত টেকনাফের আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ একসময় চলে আসে বদির হাতে। রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠেন তিনি। পাশাপাশি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন দলের সঙ্গেও গড়ে তোলেন সুসম্পর্ক।

মাদকের রাজধানী টেকনাফ : এমপি বদির কারণে টেকনাফ হয়ে ওঠে মাদকের রাজধানী। ইয়াবার জোয়ারে তাই ভাসে গোটা টেকনাফ। এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান ব্যবসাই হয়ে ওঠে ইয়াবা। টেকনাফের রাজনীতি আর অর্থনীতি- সব ইয়াবাকে কেন্দ্র করেই চলে। জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি থেকে শুরু করে এমন কোনো সেক্টর নেই যে, যাদের ইয়াবার ব্যবসায়ে জড়িত করেননি বদি। ইয়াবাকে বদি এতটাই লাভজনক ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, লবণ চাষ, মাছ চাষ, কাঠ ব্যবসাসহ বিভিন্ন বৈধ ব্যবসা ছেড়ে শত শত ব্যবসায়ী ইয়াবায় অর্থ লগ্নি করছে। আর এসব কারণে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা টেকনাফ হয়ে উঠেছে মাদকের স্বর্গরাজ্য। মাফিয়াদের বিচরণে মুখর থাকে সুন্দরের লীলাভূমি এই টেকনাফ।

টেকনাফের সাধারণ মানুষের অভিযোগ, ইয়াবার বাংলাদেশের গডফাদার এমপি বদির পরিবারের হাতে। টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, এমপির সঙ্গে সব সময় চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের চলাফেরা। এমপির ভাই, বন্ধু ও সহযোগীরা বেপরোয়া ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটি এমপির ক্ষমতার জোরেই চলছে, এ কথা সবাই জানে। এমপির এই ইয়াবা ব্যবসার কথা জানে সরকার ও দল। এর পরও তারা কিছু করছে না। এখানকার সাধারণ মানুষ এমপি এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কাছে অসহায়। মাঝে-মধ্যে পুলিশ অভিযান চালায়। ক্রসফায়ার হয়। কিন্তু বড় মাছগুলো সব সময় থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ক্ষমতার কাছে থাকায় ইয়াবা ব্যবসার বদি ও তার লোকজন সব সময়ই থাকে প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বার বার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম এলেও তারা প্রকাশ্যেই ইয়াবার রাজ্যে দাপিয়ে বেড়ান। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এতটাই প্রভাবশালী যে, জেলা আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে বিষয়টি তোলার কেউ সাহস করেন না। কেউ বিষয়টি তুললেও এমপি বদি রেগে ফেটে পড়েন। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক ইয়াবার চালানও ছাড়িয়ে নিয়ে যান এমপি বদি। ইয়াবা পাচারে কখনো কখনো বদির গাড়িও ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্রমতে, শুধু তা-ই নয়, এমপি বদি ও তার স্ত্রীর গাড়ি থেকে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। সর্বশেষ গত বছর আগস্ট মাসে কুমিল্লায় বদির উপস্থিতিতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার গাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করে। কিন্তু বিতর্কিত এ সংসদ সদস্য প্রভাব খাটিয়ে পুরো ইয়াবার চালান নিয়েই ঢাকায় আসেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা দেশের ৩১ জন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ভাই-বেয়াই, মামা-ভাগ্নে মিলিয়ে বদিসহ ১০ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে।

সন্ত্রাস ও দখলবাজি : অনুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনাফ স্থলবন্দর, হাট-বাজার, ঠিকাদারি, পরিবহন, পর্যটকবাহী জাহাজ, টার্মিনাল, জেটিসহ সীমান্ত চোরাচালান ব্যবসা পুরো নিয়ন্ত্রণে নেন এমপি বদি। সঙ্গে রয়েছেন তার ছোট ভাই আবদুল আমিন। এখন আবদুল আমিনের ইচ্ছা অনুযায়ী টেকনাফ বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে।

এমপির নিজস্ব বন্দর বলে খ্যাত অবৈধ কাইয়ুকখালী ঘাটের চিংড়ি মাছ, কাঠ, ফলমূল আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেন তার আরেক ভগ্নিপতি গিয়াস উদ্দীন ও ফুফাতো ভাই সৈয়দ আলম। এমপি তার প্রভাব খাটিয়ে মিয়ানমার থেকে আনা মালামাল অবৈধভাবে এ ঘাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেন। এই বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ চোরাই পণ্য মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।

মারধরে পারদর্শী : এদিকে ‘অবাধ্যতার দায়ে’ বিভিন্ন সময় এমপি বদি নিজেই মারধর করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজারের চারটি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের একমাত্র এমপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২৩ দিন পর টেকনাফ উপজেলা নির্বাচনের দিন একটি ভোটকেন্দ্রে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিনকে মারধর করেন বদি। এর পর তার হাতে প্রহৃত হন টেকনাফের বন বিট কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান। সরকারি কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক, আইনজীবী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ কেউ বাদ যাননি।



মন্তব্য চালু নেই