যেভাবে সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছিলেন মেজর জিয়া

যে বরখাস্ত মেজর জিয়াউল হককে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে সেই মেজর জিয়া সেনাবাহিনীতে থাকার সময় ২০১১ সালের ডিসেম্বরে একটি অভ্যুত্থান চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

সেই অভ্যুত্থান চেষ্টার মাসখানেক পর সেনাবাহিনী সংবাদ সম্মেলন করে ওই অভ্যুত্থান চেষ্টা নস্যাতের কথা জানিয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে এরকম সংবাদ সম্মেলন সেটাই ছিল প্রথম।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে সেনা সদর দপ্তরে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল, অবসরপ্রাপ্ত এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত কিছু ধর্মান্ধ কর্মকর্তা অন্যদের ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করার একটি বিফল প্রয়াস চালিয়েছিল।

‘এই অপপ্রয়াসটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিহত করা হয়েছে।’

অপপ্রয়াসের পেছনে কিছু প্রবাসী বাংলাদেশীর ইন্ধন ছিল জানিয়ে তখন বলা হয়, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী নাগরিক ইশরাক আহমেদ তাদের অন্যতম। ইশরাক হংকংপ্রবাসী ধারণা করে জানানো হয়, তার বাবা এম রাকিব আর তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার বারশাইল ইউনিয়নের বালুভাড়া গ্রামে।

সেনা সদরের সংবাদ সম্মেলনে এও জানানো হয়, ওই ঘটনায় অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এহসান ইউসুফ ছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাকিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ বিষয়ে একটি তদন্ত আদালত গঠনের কথাও জানায় সেনা সদর।

তবে তার আগেই মেজর জিয়া পালিয়ে যায় বলে তাকে অবিলম্বে সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়।

বিস্তারিত জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ১৩ ডিসেম্বর (২০১১) একজন কর্মরত মেজর পদবির কর্মকর্তাকে ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যোগদানের প্ররোচণা দেওয়া হলে ওই কর্মকর্তা তাৎক্ষণিক বিষয়টি তার চেইন অব কমান্ডের মাধ্যমে জানালে কর্নেল এহসানকে সেনাবাহিনী আইনের ২১ডির এবং ৭৩ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়।

‘সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াসের অন্য পরিকল্পনাকারী মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক গত ২২ ডিসেম্বর (২০১১) অন্য এক কর্মরত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে তাকেও রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড তথা সেনাবাহিনীকে অপব্যবহার করার কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে প্ররোচনা দেন। ওই কর্মকর্তা বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবগত করলে সদ্য দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ সম্পন্নকারী মেজর জিয়ার ছুটি ও বদলি আদেশ বাতিল করে তাকে সত্বর ঢাকার লগ এরিয়া সদর দপ্তরে যোগ দিতে বলা হয়। বিষয়টি টেলিফোনে গত ২৩ ডিসেম্বর তাকে জানানো হলেও তিনি পলাতক থাকেন।’

সেনা সদর তখন জানায়, পলাতক অবস্থায় মেজর জিয়া সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাবভারসিভ (নাশকতামূলক) কার্যক্রম চালানোর পাঁয়তারা করেন এবং এখনো করছেন।

এ ছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাকির একজন চাকরিরত কর্মকর্তাকে সরকারের প্রতি আনুগত্য পরিত্যাগ করার প্ররোচনা দেন। এ অভিযোগে গত ৩১ ডিসেম্বর (২০১১) সংশ্লিষ্ট সেনা আইনের ধারায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সেনা সদরের ওই সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের আংশিক তথ্যাদি ফাঁস হয়ে যাওয়া ও কিছু ব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৬ ডিসেম্বর (২০১১) ১০টা ৫২ মিনিটে পলাতক মেজর জিয়া তাকে তথাকথিত গ্রেপ্তার ও নির্যাতনসংক্রান্ত কল্পনাপ্রসূত ও অবিশ্বাস্য গল্প বর্ণনা করে একটি উসকানিমূলক ই-মেইল তার পরিচিতদের পাঠান, যা পরবর্তী সময়ে সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুকে আবু সাঈদ নামে একজন আপলোড করেন।

‘পরে মেজর জিয়া Mid-level Officers of Bangladesh Army are bringing Down changes soon এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নতুন বছরের উপহার- মধ্যম সারির অফিসাররা অচিরেই বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন শিরোনামে কাল্পনিক ও অত্যন্ত বিতর্কিত বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে দুটি ই-মেইল ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন। গত ৩ জানুয়ারি একটি পত্রিকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে দেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াসে পলাতক মেজর জিয়ার ওই ইন্টারনেট বার্তাটি প্রকাশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৮ জানুয়ারি নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মান্ধ হিযবুত তাহরির পলাতক মেজর জিয়ার ইন্টারনেট বার্তাটিকে ভিত্তি করে দেশব্যাপী উসকানিমূলক লিফলেট ছড়ায়। এর এক দিন পর গত ৯ জানুয়ারি দেশের একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলও উপরোক্ত মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও প্রচারণামূলক সংবাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেনাবাহিনীতে গুমের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ করে, যা সেনাবাহিনী তথা সচেতন নাগরিকদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত উসকানিমূলক বিতর্ক সৃষ্টি করে,’ বলে সেনা সদরের সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়।

লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, গ্রেপ্তার অবসরপ্রাপ্ত দুজন কর্মকর্তা ও অন্য চাকরিরত কর্মকর্তাদের দেওয়া বিস্তারিত তথ্য অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ঘাড়ে ভর করে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে উৎখাতের ঘৃণ্য চক্রান্তের সঙ্গে সেনাবাহিনীতে চাকরিরত কিছু কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। কিছু বিশৃঙ্খল ও পথভ্রষ্ট সামরিক কর্মকর্তা মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার করে পলাতক মেজর জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে ওই ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চক্রান্তে সক্রিয়ভাবে লিপ্ত থাকেন। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য গত ২৮ ডিসেম্বর (২০১১) একটি তদন্ত আদালতও গঠন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গত ৯ ও ১০ জানুয়ারি (২০১২) পলাতক মেজর জিয়া তাঁর কল্পিত দুটি অপারেশন আদেশ/নির্দেশের কপি ই-মেইলের মাধ্যমে চাকরিরত বিভিন্ন অফিসারের কাছে পাঠান। এ ছাড়া ১০ জানুয়ারি (২০১২) মেজর জিয়া বিভিন্ন ফরমেশন ও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত/অধ্যয়নরত সমমনা বা তাদের দলভুক্ত কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তাঁদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তথাকথিত সেনা অভ্যুত্থান-সংক্রান্ত প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চান এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বারবার উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। একই রাতে পলাতক মেজর জিয়া বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিক ইশরাক আহমেদের সঙ্গে কয়েকবার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। কথোপকথনে তাঁরা অভ্যুত্থানের অগ্রগতি ও তা সম্পাদনপ্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন।

‘এ সময় পলাতক মেজর জিয়া তাকে বিদেশে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানের বিষয়টি প্রচার করার জন্য বলেন। ইশরাক পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনা অভ্যুত্থান বাস্তবায়ন শেষ হলে ১০ জানুয়ারি রাত আনুমানিক ২টার সময় টেলিফোন করতে বলেন, যাতে তিনি কম সময়ের মধ্যে বিমানযোগে বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারেন। ধারণা করা যায়, বিশৃঙ্খলা-পরবর্তী সুবিধা প্রাপ্তির জন্যই ইশরাকের বাংলাদেশে আসার এই পরিকল্পনা ছিল।’

সেনাবাহিনীর ওই সংবাদ সম্মেলনে তখন একথাও বলা হয়, গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সরকারের অধীনে থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যখন বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি গুণগতমানে সমৃদ্ধ বাহিনী হিসেবে সংগঠিত হওয়ার প্রয়াসে লিপ্ত; তখনই অতীতের গণতন্ত্র ধ্বংসের বিভিন্ন অপশক্তি দেশপ্রেমিক একটি রাষ্ট্রীয় শক্তি সেনাবাহিনীর ওপর সওয়ার হওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। তাঁরা নিকট ও দূর অতীতের ন্যায় এবারও ধর্মান্ধের অনুভূতি, অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানোর প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করেছে। এসব ঘৃণ্য চক্রান্তকারীদের দোসর হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন পালনে হঠাৎ অতিমাত্রায় কট্টর এবং পারিবারিক বন্ধন, চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিরা। অপপ্রচার চালানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে স্বার্থান্বেষী সংবাদপত্র, নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের প্ল্যাটফর্ম।



মন্তব্য চালু নেই