যে কারণে এত জনপ্রিয় এসপি বাবুল আক্তার

একের পর এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার আর অস্ত্র উদ্ধার ও জঙ্গি আস্তানা উচ্ছেদ করে সব মহলে প্রশংসিত হয়েছেন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। বিপদে পড়লেই সাধারণ মানুষ দ্বারস্থ হয় তার। কারণ সবাই জানে বাবুল আক্তার পুলিশ বিভাগে সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অসহায়-নির্যাতিতদের পরম বন্ধু। সাংবাদিকদের কাছে তিনি ছিলেন খবরের প্রধানতম উৎস। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তিনি নিজেই এখন খবর হয়ে গেলেন।

রোববার সকালে তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার ওরফে মিতু দুর্বৃত্তদের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়ার পর সারা দেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তিনি।

গত ৫ এপ্রিল পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে সিএমপি থেকে যোগদান করেন ঢাকা পুলিশ সদর দফতরে। অপরাধ দমনে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে বাবুল আক্তার পুলিশ বাহিনী থেকে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কারও।

বাবুল আক্তারের সাহসী যত কর্মকাণ্ড
২০০৭ সালে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেন নরসিংদীতে সংঘটিত ছয় খুনের রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব। নরসিংদীর ভেলানগরে ওই বছরের ১৮ মে একই পরিবারের ছয় সদস্যকে খুন করে ঘরের ভেতরেই লাশগুলো বস্তাভর্তি করে রাখা হয়েছিল চার দিন। ঘটনার তদন্তের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি চান র‌্যাব অফিসার বাবুল। অনুমতি পাওয়ার পর শুরু করেন অভিযান।

ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব ঘুরে গ্রেফতার করেন ঘটনার মূল হোতা বীরুকে। তার সূত্র ধরে পুরো হত্যারহস্য উন্মোচন করে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। মামলার বিচার শেষে আসামিদের ফাঁসির রায় দেন আদালত।

এছাড়া স্কুলশিক্ষিকা তানিয়া হত্যারহস্য উদ্ঘাটন, ১৪ বছরের কিশোর জাভেদকে অপহরণকারীদের হাত থেকে অক্ষত উদ্ধার ও অপহরণরহস্য উদ্ঘাটন, গৃহকর্মী রুমাকে হত্যার পর পুড়িয়ে সব আলামত নষ্টের পরও সূত্রহীন সেই হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করে আসামিদের গ্রেফতার, রাউজানের বেসরকারি ব্যাংকের ভল্ট থেকে সাড়ে ৩৪ লাখ টাকা চুরির হোতা গ্রাজুয়েট চোরচক্রকে গ্রেফতার, চট্টগ্রামের ভয়ংকর ডাকাত সর্দার খলিলকে নয় সহযোগীসহ গ্রেফতার ও মালামাল উদ্ধার, অজ্ঞান-মলমপার্টি-মোটরসাইকেল চোরচক্র গ্রেফতার, সিএনজি চোর ও গামছা পার্টি আবিষ্কার, ডাকাতির প্রস্তুতির সময় রকেট লঞ্চার, ছয় অস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদ উদ্ধার, রাউজানের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বিধান বড়ুয়ার কাছ থেকে জি-থ্রি রাইফেল উদ্ধার, চট্টগ্রামের কাদের ডাকাত ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলার ত্রাস কিলার ওসমানকে গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করেছেন বাবুল আক্তার।

২০১৩ সালে কক্সবাজারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় গ্রেফতার করেন বেশ ক’জন দুর্ধর্ষ জলদস্যুকে। এ কারণে এলাকায় জেলেরা মিষ্টি বিতরণ করেছিল। র‌্যাবে থাকাকালীন পুরান ঢাকা থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার জাল সনদ, সনদ তৈরির কারখানা এবং এই অপকর্মের দুই হোতাকে আটক করেন বাবুল আক্তার।

তিনি অনুসন্ধান করে ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর এলাকায় সন্ধান পান জেএমবির আস্তানার। সেখান থেকে ৮টি হ্যান্ডগ্রেনেড ও বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ জেএমবির সামরিক প্রধান জাবেদসহ আটক করা হয় পাঁচজনকে।

জাবেদকে নিয়ে পরদিন ৬ অক্টোবর ভোরে পুলিশ আরেকটি অভিযানে গেলে তার সহকর্মীদের ছোঁড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত হয় জাবেদ।

কর্মজীবন:
পুলিশের ২৪ তম ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা বাবুল আক্তার ২০০৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে র‌্যাব-২-এ কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার পদে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি জেলা পুলিশের হাটহাজারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার পদেও কর্মরত ছিলেন।

পরে পদোন্নতি পেয়ে বাবুল আক্তার দীর্ঘদিন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর বদলি হয়ে সিএমপিতে যোগ দেন। ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে যোগ দিয়ে দক্ষিণ সুদান গিয়েছিলেন বাবুল আক্তার। ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই তিনি দেশে ফিরে নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ সদর দফতরে যোগদান করেন।

তবে সিএমপির অপরাধ দমনে আলোচিত চেৌকস পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে চাহিদাপত্র দিয়ে সিএমপিতে আনেন পুলিশ কমিশনার আব্দুল জলিল মন্ডল। এরপর ছুটি কাটিয়ে ২৬ আগস্ট সিএমপিতে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হিসেবে যোগদান করেন।

চলতি বছরের ৫ এপ্রিল তাঁর পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি হলে তিনি সিএমপি থেকে ঢাকা পুলিশ সদর দফতরে যোগদান করেন। ঘটনা এমন হয়েছিল যে- হাটহাজারী এবং কক্সবাজার থেকে বাবুল আক্তারের বদলি ঠেকাতে জনতা রাজপথে নেমে এসেছিল।

পরিচয়:
বাবুল আক্তার ১৯৭৫ সালে ঝিনাইদহের শৈলকুপার মদনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুল ওয়াদুদ মিয়া ও মা শাহিদা বেগম। ২০০৪ সালে মাহমুদা আক্তারের সঙ্গে সংসারজীবন শুরু করেন। তাদের সংসারে দুই সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহির ও আক্তার তাবাচ্ছুম তানজিলা। মাহির ক্যান্টেনমেন্ট পাবলিক স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে।

স্বীকৃতি:
অপরাধ দমনে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে বাবুল আক্তার পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক পিপিএম (সেবা) (২০০৮), ২০০৯ পিপিএম (সাহসিকতা), ২০১০ সালে আইজিপি ব্যাজ, ২০১১ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল পুরস্কার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (সাহসিকতা)। সর্বশেষ বেসরকারি পর্যায়ে ২০১২ সালে সিঙ্গার-চ্যানেল আই (সাহসিকতা) পুরস্কার লাভ করেছেন বাবুল আক্তার। এর মধ্যে চারবার অর্জন করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের সেরা সহকারী পুলিশ সুপারের মর্যাদা।



মন্তব্য চালু নেই