যে দেশের সবাই কোটিপতি! একটি সুখি দেশের গল্প

ইউরোপের ছোট্ট দেশ লুক্সেমবুর্গ। ১ হাজার বর্গমাইল আয়তনের পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত দেশটিতে বাস করে প্রায় ৫ লাখেরও কম মানুষ। এ দেশের মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় প্রায় ৪৬ লাখ টাকা। ২০০৬ সালের জাতিসঙ্ঘের রিপোর্টে তাদের আয়ের এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে।

বার্ষিক অর্ধকোটি টাকা আয়ের দেশটিতে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণও চোখে পড়ার মত। দেশটিতে অত্যধিক উন্নত সত্ত্বেও তাদের অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি সে হারে কমছে না।

লুক্সেমবুর্গে মুদ্রাস্ফীতি নেই। নেই বেকারত্ব। আর বেকার থাকলেও তারা রয়েছে রাজার হালে। সরকারি নানা সামাজিক সেবা তাদের আরাম-আয়েশকে নিশ্চিত করেছে। উপোস থাকার কথা চিন্তাই করা যায় না। দেশটির অর্থনীতির মূলে স্টিল ইন্ডাস্ট্রি।

গত শতাব্দির ষাটের দশকে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। ক্রমান্বয়ে রসায়ন, রাবার এবং অন্য কয়েকটি শিল্পের বিকাশ স্টিল শিল্পের আয়কে ম্লান করে দেয়। বিগত শতাব্দীর শেষ দু’টি দশকে দেশটির সেবা খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তাদের দারুণ সম্পর্ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিবেশী দুটো দেশ বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডের সাথে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক সম্পর্ক তাদের উন্নতির অন্যতম চূড়ায় নিয়ে যায়। তার ওপর দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে বাণিজ্য সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে। উন্নত জীবনমানের বিচারে তারা বিশ্বের চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। দেশটির যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। টেলিকমিউনিকেশন সুবিধা এতটা উন্নত যা চিন্তাও করা যায় না। ফিক্সড ফোনের সংখ্যা এবং জনসংখ্যা প্রায় সমান। তার ওপর সেলফোন তো রয়েছেই। বলতে গেলে সবার হাতেই রয়েছে একটি করে সেলফোন।

[এক নজরে লুক্সেমবুর্গ

পুরো নাম : গ্রান্ড ডাচি অব লুক্সেমবুর্গ
জনসংখ্যা : ৪ লাখ ৬৫ হাজার (জাতিসঙ্ঘ ২০০৫)
রাজধানী : লুক্সেমবুর্গ
আয়তন : ৯৯৯ বর্গমাইল
প্রধান ভাষা : ফ্রেন্স, জার্মান ও লুক্সেমবুর্গিস
প্রধান ধর্ম : খ্রিস্টান
গড় আয়ু : ৭৫ বছর (পুরুষ), ৮১ বছর (মহিলা)
মুদ্রা : ইউরো
প্রধান রফতানি দ্রব্য : স্টিলের তৈরি সামগ্রী, রাসায়নিক ও রাবার সামগ্রী
মাথাপিছু আয় : ৬৫ হাজার ৬৩০ মার্কিন ডলার]

উন্নত দেশটির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। লুউচিলিনবার্গ নামক একটি গির্জার অস্তিত্ব ছিল ওই অঞ্চলে। গির্জাটিকে কেন্দ্র করে এলাকাটির সম্প্রসারণ ঘটে। গির্জার নাম অনুসারে এলাকাটির নামকরণ হয় লুক্সেমবুর্গ। দ্রুত সেখানে একটি শহুরে সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। ভৌগোলিকভাবে এলাকাটি কৌশলগত গুরুত্বের দাবিদার। নবগঠিত এ সভ্য সমাজে রাজাকেন্দ্রিক একটি শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়। পুরুষ উত্তরাধিকার না থাকায় ১৪৩৭ সালে শাসক পরিবর্তন হয়। বুরবন্স, হাব্সবার্গ, হোহেনজোলান্সদের হাত ঘুরে এটি যায় ফ্রান্সের হাতে। ১৮১৫ সালে নেপোলিয়ানের পতন হলে লুক্সেমবুর্গকে নিয়ে প্র“শিয়া ও নেদারল্যান্ডের মধ্যে বিরোধ বাধে। পরে একটি ইউরোপীয় আপস-মীমাংসায় দেশটিকে নেদারল্যান্ডের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। পরে এটি জার্মান কনফেডারেশনেরও অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৮৩০ থেকে ১৮৩৯ সালে বেলজিয়ামের বিপ্লবের সময় দেশটি বিরাট অংশ হারায়। লন্ডনের সাথে এক চুক্তির পর দেশটি নিরপত্তার নীতি গ্রহণ করে। ১৮৯০ সাল পর্যন্ত বেলজিয়াম দেশটির ওপর কর্তৃত্ব করে। প্রথম ও দ্বিতীয় দু’টি বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই লুক্সেমবুর্গকে দখল করে জার্মানি। কিন্তু জার্মানরা তাদের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের ওপর হাত দেয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশটি তারা প্রথম নিরপত্তার নীতি পরিত্যাগ করে। এ সময় জার্মানির পে যুদ্ধে অংশ নেয় তারা।

দেশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দু’টি সংস্থা জাতিসঙ্ঘ ও ন্যাটোর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিউনিটিরও উদ্যোক্তা ছ’টি দেশের একটি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব বড় বড় উদ্যোগ এগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় এ ক্ষুদ্র দেশটি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ন্যাটো জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথেও শুরু থেকে বিভিন্ন জোট গঠন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সেগুলোকে কাজে লাগায়।
লুক্সেমবুর্গে রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রচলিত। রাজা নির্বাচনের ক্ষেত্রে পুরুষ প্রতিনিধিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। রাজা এবং প্রধানমন্ত্রী মিলে রাষ্ট্রের নির্বাহী মতা প্রয়োগ করেন। গ্রান্ড ডিউক নামে পরিচিত রাজার সংসদ ভেঙে দেয়ার মতা রয়েছে। এক কবিশিষ্ট সংসদের ৬০টি আসন। সরকার পরিচালনায় দ্বিতীয় মতাধর হচ্ছেন রাজা নিয়োগকৃত ২১ সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিল অব স্টেট। দেশটি তিনটি জেলায় বিভক্ত। এগুলো আবার ১২ ক্যান্টন এবং ১১৬টি কমিউনে বিভক্ত। হেড অব স্টেট গ্রান্ড ডিউক হেনরি।

উন্নত নাগরিক সুবিধার কারণে ইউরোপীয়দের ঢল নামছে দেশটিতে। সুবিধাবঞ্চিতরা অভিবাসী হতে চায় লুক্সেমবুর্গে। মূলত দেশটিতে ফ্রেন্স ও জার্মান বংশোদ্ভূতদের বসতি। তবে বিংশ শতকে বেলজিয়াম, ইতালি ও পর্তুগাল থেকে উন্নত জীবনের আশায় অনেকে এসে বসতি স্থাপন করে। যুগোস্লাভ যুদ্ধের সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত বলকান অঞ্চল বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো ও সার্বিয়া থেকেও অনেকে দেশটিতে প্রবেশ করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে সাম্প্রতিক প্রতি বছরে গড়ে ১০ হাজার মানুষ লুক্সেমবুর্গে অভিবাসী হয়। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৭ শতাংশই অভিবাসী।

দেশের সেনাবাহিনীর আকারও ছোট। একজন কর্নেলের নেতৃত্বে দেশটিতে ৪৫০ জন সেনাসদস্য রয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর আকার ছোট তাই বলে তাদের কার্যক্রম সীমিত তা বলার জো নেই। বাজেট দেখলেই তা টের পাওয়া যায়। দেশটির সামরিক খাতে বার্ষিক ব্যয় ১২ কোটি ডলার। জাতিসঙ্ঘ ও ন্যাটোর অধীনে লুক্সেমবুর্গের সেনাবাহিনী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিশনে যথারীতি অংশ নেয়। যুগোস্লাভিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রায় প্রত্যেকটি দেশে শান্তি মিশনে তারা অংশ নিয়েছে।

ছোট দেশের ছোট জনসংখ্যা কিন্তু ভাষার বৈচিত্র্য রয়েছে বেশ। তিনটি প্রধান ভাষায় সমানতালে কথা বলে মানুষ। এগুলো হলো জার্মান, ফ্রেন্স আর লুক্সেমবুর্গিস। তিনটি ভাষা দেশটির অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এ ছাড়াও বেশ কিছু স্থানীয় ও আঞ্চলিক ভাষা সক্রিয় রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। স্কুলে ইংরেজি ভাষা শিা বাধ্যতামূলক।
লুক্সেমবুর্গ একটি সেকুলার দেশ। ধর্মবিশ্বাসীদের ব্যাপারে কোনো পরিসংখ্যানের তত্ত্ব-তালাশ দেশটিতে নিষিদ্ধ। ধারণা মতে, দেশটির ৮৭ শতাংশ মানুষ রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের। বাকিদের মধ্যে খ্রিস্টানদের অন্যান্য সম্প্রদায়, ইহুদি এবং মুসলিম রয়েছে।
লুক্সেমবুর্গের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ। সরকার ইতিহাস-ঐতিহ্য আর উন্নত সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে নানা ধরনের পদপে নিয়েছে। এর মধ্যে জাদুঘরগুলো অন্যতম। এগুলো হলো ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব হিস্ট্রি অ্যান্ড আর্ট, হিস্ট্রি মিউজিয়াম অব দ্য সিটি অব লুক্সেমবুর্গ, গ্রান্ড ডিউক জ্যঁ মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট অন্যতম।

এ ছাড়া ইউরোপীয় সামরিক শক্তির স্মারক ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব মিলিটারি হিস্ট্রি। ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে লুক্সেমবুর্গ শহরটিই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। শহরটি ২০০৭ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোপিয়ান ক্যাপিটাল কালচারের খেতাব পেয়েছে। শিল্প এবং শিল্পীর দারুণ কদর রয়েছে লুক্সেমবুর্গে।
দেশটির গণমাধ্যম অভাবনীয় উন্নতিসাধন করেছে। তাদের রেডিও ও টেলিভিশন সেবা পুরো ইউরোপ ভোগ করে। দেশটি ইউরোপের সবচেয়ে বৃহৎ স্যাটেলাইট অপারেটর। সংবিধান জনগণের মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। সংবাদপত্রেরও ব্যাপক প্রচলন রয়েছে সেখানে। টেলিভিশন ও রেডিও দেশটির বিনোদনের প্রধান মাধ্যম কিন্তু জনগণের যাবতীয় মতামতের প্রতিফলন ঘটায় সংবাদপত্র। সরকার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়।



মন্তব্য চালু নেই