যে রাজ্যে বুকে আঁচল দিতে খাজনা লাগতো

মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার আত্মমর্যাদা বোধ আছে। কেউ সেই মর্যাদাবোধ ক্ষুণ্ণ করলে মানুষ তা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়ে দিতে পারে। এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে মানুষের ভেতরে এই বৈশিষ্ট্য আছে। তবে সব মানুষের ভেতরে কিন্তু আত্মমর্যাদা নেই। অনেকে জানেই না আত্মমর্যাদার সংজ্ঞা কি? মানুষে মানুষে এখানেই তফাৎ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে সত্য এবং ন্যায়ের পক্ষ নিয়ে আত্মমর্যাদা রক্ষা করে গেছে হাতে গোনা অল্প কয়েকজন মানুষ। এরা মহৎ মানুষ। এরা সব দুর্বল মানুষের পক্ষ নিয়ে নিজের জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে মানুষের আত্মমর্যাদাবোধ এবং এর তীব্রতা। এরকম একটা মর্যাদা রক্ষার বিরল ঘটনা ঘটেছিল দুইশ বছর আগে ভারতের কেরালাতে।

মুলাচি-পারাম্বু হচ্ছে ভারতের কেরালার আলাপুজা জেলার চেরথালা শহরের উত্তর দিকের একটা এলাকা। মুলাচি-পারাম্বু নামের প্রথম শব্দ ‘মুলাচি’ নির্দেশ করে নারীর বক্ষকে। এই সম্বোধন সাধারণ কোনো নারী থেকে আসেনি, এসেছে অত্যন্ত সাহসী একজন নারীর স্মরণে। বিশ শতকের শুরুর দিকে চেরথালা শহরে বাস করতেন ‘নাঞ্জেলি’ নামের এক নারী। নাঞ্জেলি নামের অর্থ সবচেয়ে সুন্দরী।

উনিশ এবং বিশ শতকে ভারতের উত্তর কেরালাতে (তৎকালীন ত্রিবাংকুর রাজ্য) শাসকরা বর্বর সব খাজনা আরোপ করতেন প্রজাদের উপর। বিশেষ করে সমাজের শ্রেণিহীন দরিদ্র প্রজাদের উপর। এরকম একটি খাজনা বসানো হয়েছিল মেয়েদের বুকের উপরে (ব্রেস্ট ট্যাক্স)। নারীদের জন্য এটা ছিল মর্যাদা হানিকর। নাঞ্জেলি এর প্রতিবাদ করে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সে এক বিস্ময়কর ঘটনা!

আঠারোশ শতকের শুরুতে ত্রিবাংকুর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন রাজা মর্থন্দ বর্মা। পার্শ্ববর্তী রাজ্য ক্যায়ামকুলামের রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে রাজ্য প্রসারিত করেন তিনি। সেইসাথে সেখানে মেয়েদের বুকের উপর ‘মুলাকরম’ এবং ‘তালাকরম’ জাতীয় বর্বর খাজনা আরোপ করেন।

2016_03_06_18_10_47_EJjSkysi4FAZrLR89JSYFy4nKEMnTo_original

তৎকালীন বাজারে বুকে আঁচল ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছেন নারীরা

বিশেষ করে ‘অবর্ণ’ বা বর্ণহীন মানুষদের উপর এরকম প্রায় একশোর বেশি খাজনা আরোপ করা হয়েছিল । অবর্ণরা হিন্দু মূল চার বর্ণের (ব্রাহ্মণ, শাস্ত্রীয়, বৈষ্ণব, শূদ্র) ভেতরে পড়ে না। তাদের দেয়া সমস্ত খাজনা গিয়ে জড়ো হতো পদ্মনভা দুর্গের কোষাগারে। এই তথ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আজকের যে বিশাল পদ্মনভা রাজস্ব ভাণ্ডার, সেটা সৃষ্টি হয়েছিল বর্ণহীন মানুষের উপরে আরোপিত জঘন্য সব খাজনা থেকে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বর্ণহীন মানুষদের উপরে কেন এরকম কর আরোপ করা হয়েছিল? সমাজের চোখে তাদেরকে ঠিক কীভাবে দেখা হতো? তাদেরকে দেখা হত সমাজের আবর্জনা হিসেবে। কারণ অবর্ণ নারীরা জনসম্মুখে তাদের বুক ঢেকে রাখতে পারতেন না। অর্থাৎ তাদের শরীরের উপরের অংশে কোন কাপড় থাকতে পারবে না। কাপড় দিয়ে বুক ঢাকতে হলে খাজনা দিতে হবে।

অবর্ণদের ভেতরে যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি, তাদের লক্ষ্য করে এই লজ্জাজনক, অমানবিক শাসনের চর্চা করা হত। তাদের উপর ব্রাহ্মণদের আরোপ করা এই জাতীয় সামাজিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে উনিশ শতকেও অনেক প্রতিবাদ হয়েছে। এরমধ্যে কেরালার আরাতুপুঝা ভেলায়ুধ পানিকর মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি এমনকি নারায়ণ গুরুর আগে অবর্ণদের জন্য স্কুল, কলেজ, পাঠাগার এবং মন্দিরের ব্যবস্থা করেছিলেন।

প্রতিবাদ করলেও নারীদের বুকের উপর আরোপিত কর বন্ধ করতে পারেনি কেউ। সেটা বন্ধ করেছিলেন শেষপর্যন্ত চেরথালা শহরের নাঞ্জেলি নামের অতি সাধারণ এক নারী। কেরালার নারী হিসেবে নাঞ্জেলিকে আরও অনেকের মত জনসম্মুখে লজ্জা পেতে হয়েছে। এই খাজনা পদ্ধতি ব্রাহ্মণদের ধর্ম এবং বর্ণ হিসেবেও মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলেছে।।

কিন্তু ত্রিভাঙ্কুরের হর্তাকর্তারা হঠাৎ শুনলেন, নাঞ্জেলি নামের এক নারী নাকি অন্যদের মত উন্মুক্ত বুকে জনসম্মুখে বের হচ্ছে না। বরং প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বুকে আঁচল দিয়ে। তারা হন্তদন্ত হয়ে নাঞ্জেলির বাসায় গিয়ে হাজির হলেন। খাজনা চাইলেন। কিন্তু খাজনা না দিয়ে নাঞ্জেলি যেটা করলেন, সেটা দেখার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। নাঞ্জেলি দুই স্তন কেটে ফেললেন সবার সামনে। খাজনা আদায়কারীরা ভয় পেয়ে পালালেন।

ঠিক এর পরের দিন নারীদের বুকের উপর খাজনা তুলে নিলেন ত্রিভাংকুরের মহারাজা স্যার মুলাম থিরুনাল। কারণ বুকের ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণে নাঞ্জেলির মৃত্যুতে জনগণ ক্ষেপে গিয়েছিলেন। ঘটনার সময় তার স্বামী কান্দাপ্পান উপস্থিত ছিলেন না। তিনি ফিরে এসে দেখলেন তার স্ত্রীর দেহ চিতায় জ্বলছে।

ভারতের সতীদাহ আইন নিয়ে অনেক আলাপ-বিলাপ হয়েছে এযাবৎ। এই প্রথায় স্বামীর মৃতদেহের চিতায় স্ত্রীর প্রাণ উৎসর্গের জন্য আইন করা হয়েছিল। কিন্তু ঠিক উল্টোটা ঘটেছে নাঞ্জেলির ক্ষেত্রে। স্বামী নিজেকেও উৎসর্গ করেছিলেন সেই চিতায়। মৃত স্ত্রীর চিতায় স্বামীর প্রাণ দেয়ার এই ঘটনা সমগ্র মানব ইতিহাসের আর কোথাও নেই। এই দম্পতির এমন অদ্ভুত আত্মত্যাগে অবর্ণ মানুষেরা রাজার হাত থেকে ওই অঞ্চলের দখল কেড়ে নিল চিরতরে। এরপর থেকেই ওই জায়গার নাম মুলাঞ্চিপারাম্বু।

নাঞ্জেলি নারী স্বাধীনতার পক্ষে যে আন্দোলন এবং উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ভারতীয় বুদ্ধিজীবী এবং লেখিকা গায়ত্রি স্পিভাক তার লেখা ‘ক্যান দ্য সাবঅলটার্ন স্পিক?’ প্রবন্ধে ভারতের একসময়কার বর্বরোচিত সতীদাহ প্রথার কারণে তৎকালীন ভূবেনেসশ্বর ভাদুরির আত্মহত্যা নিয়ে জটিল বিশ্লেষণ করেছেন। অথচ আরেক সাহসী নারীর আত্মত্যাগ জড়িয়ে রয়েছে এইরকমই আরেকটি ঘটনায়। নাঞ্জেলির যেমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, সেইসাথে তার স্বামীও করেছিলেন। চিতার আগুনে আত্মত্যাগ করে সতীদাহর মত পুরুষতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রতিবাদ করে গিয়েছিলেন।

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, নাঞ্জেলির শহর চেরথালার মানুষ তার কথা মনে রাখেনি। জায়গাটাও বদলে গেছে। কয়েকভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে। ওই জায়গার নাম এখন মনোরমা কাভালা। মানুষের সাম্য, অধিকার এবং আত্মমর্যাদা রক্ষায় নাঞ্জেলির এই বিস্মৃতি লজ্জাকর। নাঞ্জেলির কিছুতেই হারিয়ে যাওয়ার কথা নয়। তাকে নিয়ে লেখকদের উপন্যাস লেখার কথা ছিল, নির্মিত হওয়ার কথা ছিল চলচ্চিত্র। এরকম একটা ইতিহাস জানার কথা ছিল শুধু ভারতের নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের। নাঞ্জেলির বেঁচে থাকার কথা ছিল মানুষের আত্মমর্যাদা রক্ষার সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে।



মন্তব্য চালু নেই