যে শিশুরা বেড়ে ওঠলো পশুর সঙ্গে…

মানুষ এবং পশুতে সম্পর্ক সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই। বন্য পশুকে মানুষ তাদের খাদ্য চাহিদা পূরণে প্রথম হত্যা করতো। নব্যপ্রস্তর যুগের শেষভাগে পশুকে মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে পোষ মানানোর কৌশল রপ্ত করে। এরপরই মূলত শুরু হল পশু আর মানুষের এক সঙ্গে পথ চলা। পশু প্রজাতির খুব অল্প সংখ্যক মানুষকেই পোষণ মানাতে পেরেছে মানুষ। পশুকে লালন পালন করে আসছে মানুষ নিজেদের প্রয়োজনেই। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এর উল্টোও ঘটেছে। অর্থাৎ পশু মানুষকে লালন পালন করেছে। জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিয়াল মোগলি বা টারজানের কথা বলছি না। বলছি বাস্তব পৃথিবীর কিছু মানবসন্তানের কথা, যারা কিনা বন্য পশুদের সঙ্গে সহবস্থান করে সেই পশুদের দ্বারাই লালিত হয়েছে। তাও আবার বিংশ শতাব্দির এই নগর সভ্যতার যুগে। আধুনিক যুগে পরিবার তথা সমাজ বিরাজমান নানা সমস্যায় জর্জরিত করে এই মানবশিশুদের সভ্যতার এই আলো ছায়ামাখা খেলাঘর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাদের ঠাঁই হয় পশু সমাজের কোনো এক প্রান্তে। সেখানেই বেড়ে উঠতে থাকে এরা। সম্প্রতি জুলিয়া ফুলারটন ব্যারেট নামের এক বৃটিশ আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় এমনই কিছু বিংশ শতাব্দির মানবশিশুর জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তব চিত্র ওঠে এসেছে।

ওক্সানা মালায়া, ইউক্রেন

ওক্সানা মালায়া, ইউক্রেনআলোকচিত্রী ব্যারেট ১৯৯১ সালে তার ‘ফেরাল চিল্ড্রেন প্রজেক্ট’ নামের একটি প্রজেক্টের জন্য ক্যামেরাবন্দী করেন এক ইউক্রেনীয় কিশোরীকে। তার নাম ওক্সানা মালায়া। মেয়েটির অতীত জীবন সম্পর্কে পরে জানা যায়, মাত্র তিন বছর বয়সে নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সে। মদ্যপ বাবা-মায়ের সঙ্গে সেই বিচ্ছিন্নতা তাকে প্রায় ছয় বছর সভ্যতার আলো থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল। এক রাতে মাতাল বাবা-মা তিন বছরের ছোট্ট ফুটফুটে মালায়াকে ঘরের বাইরে রেখে আসে। মালায়া হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করে এক কুকুরের ঘরে। সেখানে কুকুরের সঙ্গেই চলতে থাকে তার বসবাস খাওয়া ঘুম ইত্যাদি। এভাবে কেটে যায় ছয়টি বছর। মালায়ার বয়স যখন নয় তখন তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। এই ছয়টি বছরে বাইরের আলো এবং মানুষের সঙ্গ বঞ্চিত মালায়ার মধ্যে শিশু আর কুকুরের মিলিত আচরণ জন্ম নেয়। আর তাই সে শুধুমাত্র ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ শব্দ দুটি ছাড়া অন্য কিছুই বলতে পারে না। যে দুটি শব্দ সেই তিন বছর বয়সে বাবমায়ের কাছে শেখা। এমনকি সে কুকুরের মত জিহ্বা বের করে নিশ্বাস নেয় এবং চিৎকার করে ওঠে। সে হাঁটেও কুকুরের মত করে। তাকে খুঁজে পাওয়ার পর ইউক্রেনের একটি ক্লিনিকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা দেওয়া হয়।

শামদেও, ভারত

শামদেও, ভারত১৯৭২ সালে ভারতের এক জঙ্গলে আনুমানিক চার বছর বয়সের এক শিশুকে খুঁজে পাওয়া যায়। সে নেকড়ের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করে খাচ্ছিল। পরবর্তীতে ওই শিশুকে শামদেও নামের এক হারিয়ে যাওয়া শিশু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাকে যখন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তখন তার নখ এবং দাঁত নেকড়ের মতোই লম্বা ধারালো ছিল। মাথার চুল ছিল জটবাঁধা। খুঁজে পাওয়ার পর তার মধ্যে মুরগী শিকার, কাঁচা মাংস খাওয়া এবং রক্ত পানের প্রতি বিশেষ আসক্তি লক্ষ্য করা গেছে। মুষ্ঠীমেয় কিছু ইশারা ইঙ্গিত ছাড়া সে কোনো ভাষাতেই কথা বলতে পারেনি। শামদেও অবশ্য ২০০৮ সালের দিকে মারা যায়।

মারিনা চাপমান, কলম্বিয়া

মারিনা চাপমান, কলম্বিয়ামারিনা চাপমান নামের এক কলম্বিয়ান বাচ্চা মেয়ে অপহৃত হয় ১৯৫৪ সালে। অপহরণকারী তাকে কলম্বিয়ার একটি জঙ্গলে ফেলে রেখে চলে যায় কোনো এক কারণে। পাঁচ বছর বয়সী মারিনা অন্য তার মতো বেড়ে ওঠা শিশুদের থেকে ভিন্ন। কারণ সে সেই নির্জন জঙ্গলে নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে টিকে থাকার দক্ষতা অর্জন করেছিল। কিন্তু পাশাপাশি কিছু পশুসুলভ আচরণও গড়ে ওঠে। চার হাত পায়ে হাটা সেগুলোর মধ্যে একটি। সে বেড়ে ওঠেছিল বানরের সঙ্গে। বর্তমানে মারিনা যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ারে দুই সন্তান এবং স্বামীসহ বসবাস করেন।

ইবানইয়া, উগান্ডা

ইবানইয়া, উগান্ডাফুলারটন ব্যারেটকে এই জঙ্গল থেকে বেঁচে ফেরা শিশুদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য উগান্ডা, ফিজি, ইউক্রেনসহ বেশ কয়েকটি দেশে গমন করতে হয়েছিল। ১৯৯১ সালে উগান্ডায় তার ক্যামেরায় ধরা পরে ইবানইয়া নামের সেদেশেরই এক শিশু। পরবর্তিতে শিশুটির অতীত থেকে জানা যায় ১৯৮৮ সালে সে নিজ চোখে তার বাবাকে দেখেছে তার মাকে খুন করতে। ঘটনার ভয়াবহতা তিন বছর বয়সী ইবানইয়াকে এতটাই আঘাত করেছিল যে সে দৌড়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে সেখানেই বানরের সঙ্গে বসবাস শুরু হয় তার। তাকে যখন পাওয়া যায় তখন তার মধ্যেও বানরের মত কিছু আচরণ পাওয়া গিয়েছিল। পরররর্তীতে তাকে একটি অনাথাশ্রমে স্থানান্তর করা হয়।

মাদিনা, রাশিয়া

পশুর সঙ্গে মানবশিশু২০১৩ সালে রাশিয়ায় মাদিনা নামের আরেকটি শিশুকে পাওয়া যায় যে দীর্ঘদিন কুকুরের সঙ্গে বসবাস করার কারণে কুকুরের আচরণ রপ্ত করেছিল। পরে জানা যায়, মাদিনাকে তার মদ্যপ ২৩ বছর বয়সী মা ঠিকমত দেখাশুনা করতো না। সে তার নিজের ঘরেই মেঝেতে শুয়ে কুকুরের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করতো এবং ঘুমাতো। এই অভ্যাস তাকে শেষ পর্যন্ত কুকুরের সঙ্গেই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার সুযোগ দিয়েছিল। রুশ সমাজকর্মীরা যখন তাকে খুঁজে পায় তখন সে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় ছিল। পাশাপাশি সে কুকুরের মত হামাগুড়ি দিয়ে চলতো এবং ঘেউ ঘেউ করার চেষ্টা করতো। মাদিনাকে পরবর্তীতে মনোচিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা হয়।

সুজিত কুমার, ফিজি

সুজিত কুমার, ফিজি১৯৭৮ সালে ফিজিতে রাস্তার ধারে সুজিত কুমার নামের আনুমানিক দশ বছরের এক কিশোরকে খুঁজে পায় সমাজ কর্মীদের একটি দল। সুজিত মুরগীর ডানার মতো দু’হাত ভাঁজ করে রেখে চলার চেষ্টা করছিল। জানা যায়, তার বাবা তাকে খুব অল্প বয়স থেকেই মুরগীর খামারে বন্দী করে রাখতো। এক সময় তার মা আত্মহত্যা করে এবং তার বাবা খুন হওয়ার পর তাকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পরে তারই দাদার কাঁধে। কিন্তু তার দাদাও তাকে পূর্বের মতোই সেই মুরগীর খামরেই বন্দী করে রাখতো।

আইভান মিশুকভ, রাশিয়া

আইভান মিশুকভ, রাশিয়াআইভান মিশুকভ নামের এক রুশ কিশোর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে রাস্তায় কুকুরের সঙ্গে বসবাস করা শুরু করে। সে মানুষের কাছ থেকে খাবার চেয়ে নিত আর তা কুকুর পালের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খেত। এভাবে দুইবছর রাস্তায় কাটানোর পর তাকে সমাজকর্মীরা সেখান থেকে নিয়ে এক অনাথাশ্রমে রেখে এসেছিল।

এগুলো সবই খুবই নিকট সময়ের সত্য ঘটনা। আর এই ঘটনাগুলোর কয়েকটির সূত্রপাত হয়েছিল পরিবারে অনাচার থেকে আবার কোনোটা সমাজের রন্ধ্রে প্রবেশ করা বিষের ছোবলে নীল হয়ে।



মন্তব্য চালু নেই