যে হৃদে ভাসমান বাড়িতে বসবাস করে আদিবাসী জেলেরা

ভরা পূর্ণিমা। জোচ্ছনাঝরা রাত। চারদিকে প্রসারিত শান্ত জল, ঝিরিঝিরি বাতাস কোথাও কোথাও ঢেউ দুলিয়ে যায়। জল ও জোচ্ছনার মিলনে আকাশ ধরা দেয় জলছবি হয়ে। নৌকাগুলো জলের ওপর দোলানো ছবি ছড়িয়ে এগিয়ে যায় সাপের মতো। থোকা থোকা আলোকোচ্ছটা চোখে পড়ে। আবছায়া জলটুঙ্গির বাতি দেখে মনে হয়, লাল চোখওয়ালা কোনো দানব দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত! নৈঃস্বর্গীক এই রূপের খেলায় কার না মন হারিয়ে যায়!!

অবাস্তব কোনো রূপকল্প নয়। মানচার হ্রদে কোনো এক রাতে নৌকা ভাসালে প্রকৃতির রূপ বন্দনার মহাকাব্য গড়গড়িয়ে বেরিয়ে আসবে, যদি রূপের জাদু গ্রাস করে। আর হৃদের জলে ভেসে ভেসে যাদের প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে, শোনা যাবে তাদের গল্প। কাঠের বড় নৌকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কীভাবে বেঁচে আছে তারা, তাও জানা যাবে।

412

 

হ্রদ। চারদিকে স্থলবেষ্টিত বিলাশ জলাধার। এমন একটি হৃদের নাম মানচার হৃদ। এই হৃদে ভাসমান কাঠের নৌকার বাড়িতে বসবাস করে আদিবাসী জেলেরা।

মানচার হ্রদ কোথায়

24

পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের জামশোরো জেলার একটি অঞ্চল সেওয়ান শরিফ। এখানেই অবস্থিত মানচার হৃদ। এর পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সিন্ধু নদ, উত্তর-পশ্চিমে কিরথার পর্বতমালা। এই পর্বতমালা থেকে নেমে আসা জলপ্রবাহে বেঁচে থাকে মানচার হৃদ। বৃষ্টির মৌসুমে হৃদের পানি নেমে আসে সিন্ধু নদে। শীতকালে এর আয়তন কমে ৩৫০ বর্গকিলোমিটরে দাঁড়ায়। কিন্তু বর্ষাকালে যৌবন উথলে ওঠে। তখন ৫৫০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে প্রসারিত হয় মানচার হৃদ। এই হৃদে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে জেলেরা। তারা আবার এই হৃদেই ভাসমান বাড়ি বানিয়ে বসবাস করে। যে কারণে মানচার হৃদের নাম হয়েছে ভাসমান গ্রাম।

ভাসমান গ্রাম

Eid-Mubarak353

হৃদের পাড় থেকে বেশ ভেতরে বড় বড় নৌকার বাড়ি দেখা যায়। এর একপাশে দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র থাকে। অন্য পাশে থাকার জায়গা ও রান্নঘর। বাইরে থেকে দেখলে ঝুপড়ির মতো মনে হলেও ভেতরটা বেশি পরিপাটি। এক একটি নৌকায় একটি পরিবার থাকতে পারে। পাশাপাশি কয়েকটি ভাসমান বাড়ি মিলে তৈরি হয় ছোট ছোট গ্রাম। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, কয়েকটি ঠোঙা জটলা পাকিয়ে পানিতে ভাসছে। আর রাতে এই দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। তারাভাসা আকাশের মতো মনে হয় মানচার হৃদ। এই হৃদে বসবাসকারী আদিবাসীরা নিজেদের মিরবাহার নামে পরিচয় দেয়।

মিরবাহার কারা

index42

সিন্ধু নদীর অববাহিকায় মিরবাহার নামে এক আদিবাসীগোষ্ঠী বসবাস করে। সিন্ধু নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে তারা। তাদের একাংশ চলে আসে মানচার হৃদে। মাছ ধরার উদ্দেশে এসে তারা এখানেই বসবাস শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে।

মিরবাহার শব্দের অর্থ সমুদ্রের অতন্দ্র প্রহরী। যে কারণে গর্ব করে জাত পরিচয় দিয়ে থাকে মানচারের জেলেরা। তারা মাল্লা নামে পরিচিত। মানচার নামে ছোট্ট একটি বাজার গড়ে উঠেছে হৃদের পাশে। যেখানে কেনাকাটা করে তারা। এই বাজারে ছাউনি দেওয়া কয়েকটি দোকান এবং একটি মসজিদ রয়েছে। হৃদ থেকে এসে মন চাইলে এই বাজারে চায়ের কাপে গলা ভেজানো যায়।

index

মিরবাহাররা হৃদে কাঠের তৈরি ছোট নৌকা দিয়ে মাছ শিকার করে। আর বড় নৌকায় বসবাস করে। বেশির ভাগ জেলে সারা রাত মাছ ধরে। তারা দিনের বেলায় ঘুমায়। কেউ কেউ সকালে বা দিনের বেলায় জাল নিয়ে বের হয়। যে যখনই মাছ ধরুক, এ কাজই তাদের একমাত্র কাজ। পাইকাররা এসে জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে নিয়ে যায়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর।



মন্তব্য চালু নেই