রমজানের শুরুতে লাগামহীন নিত্যপণ্যের বাজার

পবিত্র রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে স্বস্তি নেই। লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। বিশেষ করে যেসব পণ্য রমজানে বেশি প্রয়োজন হয়, এমন পণ্যের দাম অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা।

রমজান শুরুর আগের দিন বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সরকারের বেধে দেওয়া দরের চেয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ১০ থেকে ২৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে খুচরা ব্যবসায়ীরা। তবে এই দাম বৃদ্ধি নিয়ে পাইকারী ব্যবসায়ীদের দুষছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, পাইকারি বাজারে মূল্য বেশি হওয়ায় বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে।

রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ছোলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়, মুসরী ডাল ১২০ টাকায়, খেসারি ডাল ৬০ টাকায়, তেল ৯৭ থেকে ১০২ টাকায়। চিনি মান বেধে ৪২ থেকে ৪৫ টাকায়। খেজুর খোলা ১৫০ টাকা, আর প্যাকেট ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কারওয়ান বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী আজিম উদ্দীন বলেন, ‘আমরা চিনি পাইকারদের কাছ থেকে ৩৯ টাকায় কিনেছি। এখন ৪৪-৪৫ টাকায় বিক্রি না করলে আমরা খাব কি?’ অন্যদিকে, টিসিবি এবং বাণিজ্যমন্ত্রণালয় বলছে, চাহিদার চেয়ে পণ্যের মজুদ দ্বিগুন আছে। ফলে দাম বাড়বে না।

বৃহস্পতিবার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মানুষের চাহিদার তুলনায় পণ্য যথেষ্ট পরিমাণ আছে। বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই। ফলে পণ্যমূল্য মানুষের হাতের নাগালেই আছে। তবে মন্ত্রীর এই দাবির পর বাজারের চিত্র দেখা গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

টিসিবির আমদানি বিভাগের কর্মকর্তা মো. হুমায়ূন কবির রাইজিংবিডিকে জানান, ‘রমজান উপলক্ষে প্রতিবছর আমাদের একটা লক্ষ্য থাকে, কি পরিমাণ পণ্য প্রয়োজন হবে? সেভাবে আমরা আমদানি করে থাকি। আর এটা করা হয় গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে। সে অনুযায়ী আমাদের যোগান থাকে। এই বছর রমজান মাসকে সামনে রেখে আমাদের মজুত আছে দ্বিগুন পরিমাণ পণ্য। যে কারণে এবার টিসিবি সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে রাখতে পারছে পণ্যের দাম।’

এই পণ্য টিসিবি খোলা বাজারে বিক্রি করছে।এ বছর খোলা বাজারে বিক্রির জন্য ৩ হাজার মেট্রিক টন তেল, দেড় হাজার মেট্রিক টন ছোলা, ১৫০ মেট্রিক টন খেজুর ও ২ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল আমদানি করা হয়েছে। তিনি বলেন, টিসিবির নির্ধারিত বাজার দর হচ্ছে- কেজিপ্রতি মসুর ডাল ১০৩ টাকা, সয়াবিন কেজিপ্রতি ৮৯ টাকা, চিনি ৩৭ টাকা, খেজুর ৮০ টাকা এবং ছোলা ৫৩ টাকা দরে বিক্রি করবে।

এর আগে টিসিবিতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মত বিনিময় সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী রমজান উপলক্ষে তেল ৯০ টাকা এবং চিনি ৩৮ থেকে ৪০ টাকার বেশি যাতে বিক্রি না করা হয় সে ব্যাপারে সতর্ক করে দেন খুচরা ব্যবসায়ীদের।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাজারে ব্যবসায়ীদের কাছে রমজান উপলক্ষ্যে সব ধরনের পণ্য চাহিদার চেয়ে দেড় গুণ বেশি আছে। তাছাড়া এখন কোনো হরতাল-অবরোধ নাই। ট্রাক ভাড়াও বেশি নয়। তাই দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

মন্ত্রী ব্যবসায়ীদের আহ্বান করে বলেন, শুধু রমজান মাসেই নয় সারা বছর পণ্যের দাম সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখবেন। তবে কোনো ব্যবসায়ী যদি বাজার কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়ায় তাহলে তাদের মঙ্গল হবে না। কারণ এতে মানুষের ক্ষতি হবে।

এ সম্পর্কে মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের খুচরা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব কাজল বলেন, ‘পাইকারী বাজার যে দর ধরে দেয় তার থেকে সর্বোচ্চ ৪ টাকা বেশি দরে আমরা বিক্রি করি। তবে পাইকারদের একটা সিন্ডিকেট আছে যার কারণে দাম বাড়ে।’

তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছে- ৯০ টাকার বেশি যাতে তেল বিক্রি না করি। কিন্তু এই দাম দিয়ে তেল কিনতেই হয়, তাই এ দামে বিক্রি করলে আমাদের চলবেনা। আর চিনি ৩৮ টাকায় বিক্রি করতে নির্দেশনা দিয়েছে। চিনি আমাদের কিনতে হচ্ছে বেশি দামে।’

মোতালেব প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আপনি বাজারে কোথাও গিয়ে পাবেন চিনি ৩৫-৩৬ টাকা কেজি? তবে চিনি ৪০ টাকার বেশি কেউ বিক্রি করছেন না বলে দাবি করেন তিনি।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মিয়াচান বলেন, ‘আমাদের বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটা দাম ঠিক করে দেওয়া হয়। এ জন্য পাইকাররা কত দামে পণ্য বিক্রি করবেন, সে অনুযায়ী বিক্রি হয়। বেশি দামে নয়।

স্বস্তি নেই মাছ-মাংস এবং সবজির বাজারেও। রমজান উপলক্ষে সবকিছুতেই ১০ থেকে ২৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে খুচরা ব্যবসায়ীরা। বেগুন গত এক সপ্তাহ আগেও ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হতো। আজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়।এছাড়া বেড়েছে পেয়াজ, মরিচ, আলু, ধনিয়া পাতা, মরিচ, পেপে, শসাসহ সব ধরনের সবজির দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেনা পড়ে বেশি, তাই বিক্রিও করতে হয় বেশি দামে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে কারওয়ান বাজারে কথা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তার ভাষায়, ‘পবিত্র রমজান মাস এলেই অস্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সাধারণের হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়। অথচ রমজান হচ্ছে সংযম এবং ত্যাগের মাস। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এই ঊর্ধŸগতির কারণে সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে উঠে এটি দু:সহ যন্ত্রণার মাস। এ কারণে প্রতি বছর একই দৃশ্য দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষের কাছে এই দু:সহ যন্ত্রণা এখন সহ্য হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, এই সময়টায় বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, রমজান মাসকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা বহুল ব্যবহৃত অনেক পণ্যে দাম কমিয়ে দেন। এছাড়াও দেওয়া হয় বিভিন্ন ধরণের ছাড়। আবার কোনো কোনো ব্যবসায়ী সাধারণের কাছে এক প্রকার বিনামূল্যে বিলি করেন রমজানের পণ্য। তারা মনে করেন, রমজান ব্যবসা বা অতি মুনাফা করার মাস নয়। তারা সংযম বা ত্যাগের মাসটি অন্যভাবে উপভোগ করেন।

আরেকজন ক্রেতা আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর দেখা যায়, যেই সরকারে থাকুক রমজানের আগে ব্যবসায়ীদের নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি সভা হয়। যেখানে মন্ত্রী ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন রকম আশ্বাস, অনুরোধ এবং হুঁশিয়ার করে দেন যে, রমজানে কোনোভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানো যাবে না। কোনো কোনো ব্যবসায়ী মন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দেন, আবার কেউ কেউ বিরোধীতাও করেন। অবশেষে রমজানের একসপ্তাহ আগে থেকেই দাম বাড়তে শুরু করে এসব পণ্যের।

তিনি বলেন, মন্ত্রীরা প্রতিবছরই বলেন, এবার বাজার কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এই পর্যন্ত বাজার কারসাজিতে জড়িতদের কোনো রকম শাস্তিও হয়নি। অথচ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে মন্ত্রীরা ঠিকই আতাত রাখেন। এমন পরিস্থিতিতে বাজার কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে? প্রশ্ন সবার। বাজার নিয়ন্ত্রনের জন্য প্রয়োজন রমজানের আগে চাহিদার চেয়ে মজুদ বাড়ানো। অন্যদিকে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সকলকে থাকতে হবে স্বক্রিয়। যদিও প্রতিবারই বাণিজ্যমন্ত্রণালয় এবং টিসিবি বলে দেয় যে, চাহিদার চেয়ে মজুদ বেশি আছে। তবে কেনো বাজার হয় নিয়ন্ত্রণহীন-তার জবাব মেলেনা কোনো দিন।



মন্তব্য চালু নেই