রাজনীতিতে কৃষক সমাজ

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি কাজই এদেশের মানুষের প্রধান পেশা। কৃষকরাই এদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কৃষক সমাজের বর্ণনাতীত অবদান রয়েছে। এদেশের কৃষক সমাজই আন্দোলন-সংগ্রামের সূত্রপাত করেছে জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে বাংগালীরা হেরে যায়। পরাজিত বাংগালী ইংরেজদের মাত্রাহীন অবর্ণনীয় নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলায় তখন কৃষি কাজ ছাড়া অন্য পেশার তেমন প্রচলন ছিল না। থাকলেও পরিসংখ্যানের হিসাবে তা নগন্য। নব্য শাসক ইংরেজরা বাংলার কৃষক সমাজের উপরি বেশি আঘাত হানে। জোর করে নীল চাষ করা, মাত্রাতিরিক্ত খাজনা-কর আদায়ে জুলুম-নির্যাতন সবি চালায় কৃষক সমাজের উপর। শোষিত-বঞ্চিত নির্যাতিত কৃষক সমাজ শোষনের বিরুদ্ধে লড়তে বাধ্য হয়। আর এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই কৃষক সমাজ প্রথম ইংরেজ বিরোধী রাজনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসাবে নিজেদেরকে আবির্ভূত করে। হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, নীল কর চাষের বিরোধীতা, এসবিতো বাংলার কৃষক সমাজের প্রত্যক্ষ বিদ্রোহের জ্বলন্ত উদাহরন তথা ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত। কৃষক সমাজকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন অব্যাহত থাকে এবং গতিশীল হয়। তাই বাংলার রাজনীতিতে কৃষক সমাজের অবদানকে স্বীকার করতেই হবে।

এটা ঠিক ভারতবর্ষে ইংরেজ বিরোধীতার মাধ্যমেই রাজনীতি সচেতনতা-রাজনীতির চর্চা প্রকৃত অর্থে শুরু হয়। ইংরেজদের আগমনের পূর্বে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষ রাজনীতি সচেতন ছিল না। সহজ সরল বাংগালী সমাজ নিজেদের আয়-রোজগার নিয়েই ব্যস্ত থাকত। রাজনীতি কিভাবে পরিচালিত হতো কিংবা রাষ্ট্রকে পরিচালনা করছে এসব বিষয়ে বাংগালীদের মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। অর্থনৈতিকভাবে স্বচছল থাকায় এবং মানুষের চাহিদা কম থাকায় মানুষ নিজেদেরকে নিয়ে তুষ্ট ছিল। এছাড়া শিক্ষা-সংস্কৃতির অভাবও মানুষকে ঘরকুনো করার অন্যতম কারন ছিল। ইংরেজদের জুলুম-শোষন-নির্যাতনের মাত্রারিক্ত প্রচলনে বাংগালী সমাজ ধীরে ধীরে প্রতিবাদী হতে বাধ্য হয়। এভাবেই কৃষকের রাজনীতি সচেতনতা বাড়ে। কৃষি নির্ভর কৃষক সমাজের উপর আঘাত আসায় কৃষক সমাজ বিদ্রোহী হয়ে উঠে। কৃষকরা রাজনীতি সচেতন হতে বাধ্য হয়। বাংলার কৃষক সমাজ এভাবেই রাজনীতিতে নিজেদেরকে জড়িয়ে দেয়। বিচ্ছিন্ন ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হলে কৃষক সামজ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এর রাজনীতির অন্যতম উৎস, অনুপ্রেরনা ছিল বাংলার কৃষক সমাজ। কথিত আছে বৃটিশ আমলে

বৃটিশ আর্শিবাদপুষ্ট কংগ্রেস বৃটিশদের দেয়া সিষ্টেমের মাধ্যমে রাজনীতিতে জড়ালেও জনসম্পৃক্ততা না পাওয়ায় কৃষক সমাজকে কাছে পেতে কৃষি সংক্রান্ত দাবী নিয়ে আন্দোলন করতে বাধ্য হয়।

বাংলার কৃষকরাই ইংরেজদের দ্বারা বেশি নির্যাতিত হয়েছিল। ইংরেজদের পালিত জমিদার-তাবেদারদের মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায়-অনাদায়ে জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে কৃষক সমাজকেই। ইংরেজ সরকারের অন্যতম আইন প্রনয়ন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা, তেভাগা নীতি, জমিদারী প্রথা বিলোপ, খাজনা করের বিরুদ্ধে আন্দোলন এসবিতো কৃষক সমাজকে কেন্দ্র করেই। ইংরেজদের মুূর্তিমান আতংক শেরে বাংলা কৃষক সমাজকে গুরুত্ব দিয়েই কৃষক সমাজ প্রজা পার্টি গঠন করেছিলেন। আজীবন সংগ্রামী নেতা মওলানা ভাসানী, হাজী দানেশ এর রাজনীতির মুলকেন্দ্র ছিল বাংলার কৃষক সমাজ। কৃষক সমাজকে অগ্রাধিকার দিয়েই তারা রাজনীতি করেছিলেন।

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় এদেশের কৃষক সমাজ যতটা আন্দোলন সম্পৃক্ত ছিলেন পাকিস্তান আমলে ততটা রাজনীতি সম্পৃক্ততা দেখা যায়নি কৃষক সমাজকে। এর অবশ্য অন্য কারনও ছিল। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় বাংলার মানুষের অন্যতম পেশাই ছিল কৃষি কাজ। এর বাইরে অন্য পেশার লোকজন ছিল কম। শোষনের মাত্রা কৃষকদের উপরি ছিল বেশি। তাছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রেও বাংগালী পিছিয়ে ছিল। শিক্ষার হার কম হওয়ায় শিক্ষিত লোকেরও সংখ্যা কম ছিল তাই সুসংগঠিত রাজনৈতিক চেতনার লোক কম ছিল। রাজনীতির মুল নিয়ন্ত্রক ছিল কৃষক। কিন্ত পাকিস্তান আমলের চিত্র ছিল ভিন্ন। শিক্ষার হারও ইংরেজদের শাসনামলের তুলনায় বেশি থাকায় ছিল মানুষের সচেতনতাও ছিল বেশি মাত্রায়। পাকিস্তান আমলে বাংগালীদের আন্দোলনের মূল টার্গেট ছিল স্বাধীনতা এখানে কৃষক সমাজ ছিল একটা অংশ মাত্র। তখন সম্মিলিতভাবেই স্বাধীনতার দাবি এক লক্ষ্যে ধাবমান ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে কৃষক সমাজ এককভাবে অংশগ্রহন না করলেও জাতীয় রাজনীতিতে কৃষক সমাজের অংশগ্রহন ছিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কৃষক সমাজকে গুরুত্ব দিয়েই আওয়ামী লীগের বিলুপ্তি ঘোষনা করে বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ) গঠন করে। যদিও বাকশাল এর রাজনীতির দর্শন নিয়ে মত বিরোধ রয়েছে। তবু সংগঠনটির নামের সাথে কৃষক সমাজকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। যা বড় অন্য রাজনৈতিক দলের নামের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কৃষক সমাজকে গুরুত্ব দেয়ার ফলে বড় রাজনৈতিক দলগুলো কৃষক সংগঠনের নামে তাদের অংগ সংগঠন গঠন করেছে। আওয়ামী লীগের অংগ সংগঠন কৃষক লীগ, বিএনপির অংগ সংগঠন জাতীয়তাবাদী কৃষক দল, জাতীয় পার্টির সংগঠন কৃষক পার্টি, বামপন্থীদের কৃষক সমিতি এছাড়া জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলাম ধর্মভিত্তিক দলগুলোরও কৃষক সংগঠন রয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলসমূহের এসব সংগঠনগুলো অন্যান্য অংগ সংগঠন-সহযোগী সংগঠনের মতো মর্যাদা পায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান রাজনীতিতে কৃষক সমাজের গুরুত্ব না থাকলেও প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায় নি। বর্তমান বিশ্বে বায়ো টেকনোলজির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হচেছ। কৃষি, কৃষক সমাজকে উপেক্ষা করে কোন দেশেরই সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। রাজনীতিতেও কৃষি-কৃষক সমাজের গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। বিশাল জনগোষ্ঠির এই ক্ষুদ্র আয়তনের দেশে কৃষি সম্পদের উপর নির্ভরশীলতার পরিধি ব্যাপক। নানান প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে আজও এদেশের কৃষক সমাজ নিরন্তর পরিশ্রম করে অবহেলিত কৃষিখাতকে টিকিয়ে রাখছেন। দেশ-মাটি-মানুষের স্বার্থে কৃষি সেক্টরকে নিয়ে ভাবতে হবে। দেশের রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদদেরকেও কৃষির সার্বিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভূমিকা রাখতে হবে। কৃষি, কৃষক সমাজকে উপেক্ষা করে কোন রাজনীতি দেশের সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম হবে না। কৃষিক্ষেত্র নিয়ে ভাবার অনেক কিছু আছে সার, কীটনাশক দ্রব্য, বীজ, কৃষি উপকরন এর সহজলভ্যতা, উৎপাদন-বিপনন এর সহজলভ্যতা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ন জাতীয় ইস্যু হিসাবে ধরে নিয়ে কাজ করতে হবে। রাজনীতিতে কৃষি, কৃষক সমাজ তথা কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তাই কৃষক সমাজকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে হবে, কৃষক সমাজকেও রাজনীতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল রাজনীতিতে কৃষি-কৃষক সমাজকে সম্পৃক্ত করা তথা কৃষি বান্ধব রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে রাজনীতিতে কৃষক সমাজের প্রকৃত উন্নয়নে এগিয়ে আসবে এটাই এখন সময়ের দাবী।

লেখক : কলামিস্ট



মন্তব্য চালু নেই