রিজার্ভ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আসলেই কি ৩ নারী জড়িত?

ব্যাংকের আইটি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও সুশাসনের অভাবকে কাজে লাগিয়ে সরিয়ে নেয়া হয় রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার। যার পরিকল্পনা হয় বছরখানেক আগেই। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশে খোলা হয় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট।

যার বড় একটি অংশ যায় ফিলিপাইনে। একটি অংশ যায় শ্রীলংকায়। এ ঘটনায় সামনে এসেছে তিন দেশের তিন নারীর নাম। কিন্তু তারা কি সত্যিই এ ঘটনার শিকার, নাকি তাদের সামনে রেখে কুশীলবরা ঘুঁটি সাজিয়েছেন— সে প্রশ্ন উঠছে।

ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) যে শাখার মাধ্যমে রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার বেরিয়ে গেছে, তার ব্যবস্থাপক ছিলেন মায়া সান্তোস দাগুইতো নামের এক নারী।

বিষয়টি আরসিবিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানতেন বলে দাবি করে আসছেন দাগুইতো। অর্থ ছাড় না করলে খুন হতে হতো— এমন মন্তব্যও করেছেন এ শাখা ব্যবস্থাপক।

আর এ ঘটনায় তাকে ফাঁসানো হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন শ্রীলংকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হাগোদা গ্যামেজ শালিকা পেরেরা। তার প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে গেছে চুরি হওয়া অর্থের ২ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইটি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদেশিক মুদ্রা-বিষয়ক বিভাগের দায়িত্বে থাকা ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানাকে।

দেশের প্রথম নারী ডেপুটি গভর্নর হিসেবে ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়োগ পান নাজনীন সুলতানা। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে পুনর্নিয়োগ দেয়া হয়। ডেপুটি গভর্নর হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১১টি বিভাগের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

১৯৮০ সালে সহকারী পরিচালক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কম্পিউটার উপবিভাগে যোগ দেন নাজনীন সুলতানা। এ বিভাগ থেকে তৈরি প্রায় ৮৫টি সফটওয়্যারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে একই বিভাগের উপপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম অ্যানালিস্ট হন নাজনীন সুলতানা।

জ্যেষ্ঠ সিস্টেম অ্যানালিস্ট হিসেবে পদোন্নতি পান ১৯৯৬ সালে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম নারী নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান এ কর্মকর্তা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইটি নিরাপত্তায় কোনো দুর্বলতা থাকলে স্বাভাবিকভাবে তার দায়ভার বিভাগটির তত্ত্বাবধানকারীর ওপর অনেকখানিই বর্তায়। দায় এড়াতে পারেন না সুইফটের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাও।

সিটিও ফোরাম বাংলাদেশের সভাপতি তপন কান্তি সরকার বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িত মূল ব্যক্তিদের এখনো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ের যারা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে তাদের কেউই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।

তবে অর্থ স্থানান্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত, তাদের দায়বদ্ধতা এক্ষেত্রে অনেক বেশি। অথচ এসব কর্মকর্তার বিষয়ে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এটি অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ চুরি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত নাম ফিলিপাইনের মাকাতি সিটিতে আরসিবিসির জুপিটার স্ট্রিট শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দাগুইতো। আরসিবিসির এ শাখার চারটি হিসাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যায় রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। তবে ব্যাংকটির শীর্ষপর্যায় বিষয়টিতে শুরু থেকেই অবগত ছিলেন বলে দাবি করে আসছেন দাগুইতো। অর্থ ছাড়ে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন— গণমাধ্যমে এমন বক্তব্যও এসেছে।

আরসিবিসির এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে ফিলিপাইনের গণমাধ্যম ইনকোয়্যারার এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া অর্থ ছাড় না করলে মায়া সান্তোস দাগুইতোকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল।

ব্যাংকটির মাকাতি সিটির জুপিটার স্ট্রিট শাখার কাস্টমার সার্ভিসের ওই কর্মকর্তা সিনেটকে জানান, অর্থ লেনদেনের সময় দাগুইতো জুপিটার ব্যাংকের একটি কক্ষে ছিলেন। তাকে সে সময় খুব ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। দাগুইতো তখন অনেক কিছুই বলছিলেন। কিন্তু আমার একটি কথাই মনে আছে।

তিনি বলছিলেন, হয় আমাকে এ অর্থ ছাড় করতে হবে, নয়তো আমি বা আমার বাবা খুন হব। তবে কার কাছ থেকে হুমকি এসেছে, সে বিষয়ে আমি জিজ্ঞাসা করিনি।

২০১৩ সালে আরসিবিসির জুপিটার স্ট্রিট শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ পান মায়া সান্তোস দাগুইতো। এর আগে ইস্টওয়েস্ট ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ইস্টওয়েস্ট ব্যাংকের ‘স্টার পারফরমারের’ তালিকায় ছিলেন এ নারী।

শ্রীলংকার একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হাগোদা গ্যামেজ শালিকা পেরেরা। তার পরিচালিত এনজিও শালিকা ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চুরি যাওয়া অর্থের মধ্য থেকে ২ কোটি ডলার তার অ্যাকাউন্টে যায়। বিষয়টি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রয়টার্সের সামনে প্রথমবারের মতো মুখ খোলেন এ নারী।

রয়টার্সকে তিনি জানান, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) থেকে তার কাছে ২ কোটি ডলার আসার কথা ছিল। তবে জাইকার সঙ্গে তার সরাসরি কোনো যোগাযোগ ছিল না। জাপানে যোগাযোগ রয়েছে এমন এক শ্রীলংকান বন্ধুর মাধ্যমে চুক্তির বিষয়টি স্থির হয়েছিল।

আমার পরিচিত ওই ব্যক্তি হয় অপরাধীদের শিকার, নয়তো তিনি নিজেই এর সঙ্গে জড়িত। তারা এ কাজে আমাদের ধোঁকা দিয়ে সংযুক্ত করেছে। তিনি এ সময় সুইফট মেসেজিং সিস্টেম থেকে আসা বার্তার একটি অনুলিপিও প্রদর্শন করেন।

শালিকা ফাউন্ডেশনের যাত্রা ২০১৪ সালে। শালিকা পেরেরার মন্তব্যের পর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তাদের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছে জাইকা। এমনকি কোনো মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমেও নয়। জাইকার মুখপাত্র নাওইউকি নেমোতো বলেন, আমাদের সঙ্গে তাদের কোনো লেনদেন নেই। তাদের সঙ্গে ঋণ বা অনুদান-বিষয়ক কোনো সম্পর্কও আমাদের নেই।

শালিকা পেরেরা বলেন, তিনি নিজে সংগ্রামী মানুষ। তার আরো চারটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, একটি গাড়ির যন্ত্রাংশের কোম্পানি, একটি নির্মাণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও অন্যটি ক্যাটারিং ফার্ম।

২০১৪ সালে তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে এত বেশি লোকসান হয়েছে যে, তিনি প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। তার মূল ব্যবসা এখন ইন্টারনেট ক্যাফেকেন্দ্রিক। বর্তমানে তিনি পিত্জা হাটের মতো কিছু রেস্টুরেন্টে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আলোচনা করছেন। সূত্র: বনিক বার্তা।



মন্তব্য চালু নেই