রিজার্ভ চুরির প্রতিবেদন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা!

গত ফেব্রুয়ারিতে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি আধুনিক যুগে সবচেয়ে মনোযোগ আকর্ষণকারী ব্যাংক ডাকাতিগুলোর একটি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। অথচ বাংলাদেশে ওই সাইবার ডাকাতির ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদনটি দিয়েছে তা এখনও প্রকাশ করেনি সরকার। সর্বশেষ গত মাসে প্রতিবেদনটি প্রকাশের কথা থাকলেও তা হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতিবেদনটি আদৌ প্রকাশ হবে কিনা তা নিয়েও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণের ভিত্তিতে ব্রিটিশ সংবাদ ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট দাবি করেছে, ‘প্রতিবেদনটি কখনও প্রকাশ্যে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে’। প্রতিবেদনটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে গুঞ্জন থাকার কথাও জানানো হয়েছে। এ ব্যাংক ডাকাতিকে রহস্যময় হিসেবে উল্লেখ করে ‘এ রহস্য রহস্যই থেকে যাবে’ বলে উদ্বেগ জানিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট।

চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়। প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার চুরির চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত হ্যাকাররা ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনে স্থানান্তরে সক্ষম হয়। ওই অর্থ ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের জুপিটার ব্রাঞ্চের চারটি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, তখন থেকে সাইবার ডাকাতি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশের চেষ্টা দুইবার থামিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। সর্বশেষ গত মাসে প্রতিবেদনটি প্রকাশের কথা থাকলেও তা হয়নি।

ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনায় সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে গত ১৫ মার্চ তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটিকে ৩০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন এবং ৭৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। সময় মতো প্রতিবেদন জমা দেয় মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি। কমিটির অপর দুই সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস। এ কমিটি গত ৩০ মে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। এ সময় অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।’

এরপর, গত ২১ জুলাই অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেন, কয়েক দিনের মধ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। কিন্তু প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চার মাস পরও প্রকাশ্যে আসেনি সেটি।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন এক মাস পর্যন্ত সাইবার ডাকাতির তথ্যটি গোপন করেছিল, ব্যাংক কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল কিনা, ভবিষ্যতে কিভাবে এ ধরনের সাইবার ডাকাতি ঠেকানো যাবে তা নির্ধারণ করাই ছিল ওই তদন্ত কমিটির কাজ। ইকোনমিস্টের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করবেন না। আর প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করায় গুঞ্জন উঠেছে যে প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা উঠে আসায় এবং ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাইবার ডাকাতির পর থেকে সরকার অবিরতভাবে বহিরাগত হ্যাকার, নিউ ইয়র্ক ফেডারেল এবং সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন বা সুইফটকে দায়ী করে আসছে।

কিন্তু কিভাবে সাইবার ডাকাতরা সুইফট কোড ব্যবহার করে নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ থেকে টাকা সরিয়ে নিতে পারলো সে ব্যাখ্যা এখনও কেউ দিতে পারেনি। কিংবা নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভও সেই কোড শনাক্ত করতে কেন ব্যর্থ হলো তার সুরাহাও পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেম হ্যাক করার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরে অবস্থান না করেই ট্রান্সফার অর্ডার দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। যদি তা সত্যি হয়, তবে এটি বিশ্বের লেনদেন ব্যবস্থার জন্য একটি বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাবে এ সাইবার ডাকাতির ক্ষেত্রে হ্যাকারদের সঙ্গে সুইফট টার্মিনালের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের যোগাযোগ থাকতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার এখনও চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপাইন থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিপাইনি প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুয়ার্তে এ ব্যাপারে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেপ্টেম্বরে ফিলিপাইনের একটি আদালত থেকে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ১৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। (চুরি যাওয়া অর্থের কিছু অংশ ব্যাংকটি উদ্ধার করতে পেরেছিল।) ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ফিলিপিনো কর্মকর্তারা হয়তো আশা করছেন বাংলাদেশিরা তাদের তাদের টাকা ফেরত নেবে এবং তারা শান্তিতে থাকবেন। তবে ফিলিপাইনে অর্থ পাচার সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঘাটতির বিপরীতে এ অর্থ নিতান্তই কম বলে উল্লেখ করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।



মন্তব্য চালু নেই