রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভে চাপ পড়ার শঙ্কা

গত কয়েক বছর ধরেই ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে দেশের অর্থনীতির আকার। বাজেটের আকার, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হারও বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স আহরণের হার কমছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব না পড়লেও রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবৈধ উপায়ে তথা হুণ্ডির মাধ্যমে প্রবাসীরা অর্থ প্রেরণ, অদক্ষ শ্রমিক বেশি পাঠানো, নির্যাতিত হয়ে বা নানা কারণে কর্মীর দেশে ফিরে আসা বা বেতন না পাওয়া এর অন্যতম কারণ। আর এর প্রভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর বড় চাপ পড়ার একটি আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।

এছাড়া প্রবাসী আয় কমে আসায় জাতীয় ভোগ প্রবণতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর ফলে অর্থবছর শেষে মোট জিডিপিতে ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে। সাধারণত রেমিট্যান্স বেসরকারি খাতের ভোগ বাড়াতে নানাভাবে সহায়তা করে। জিডিপি পরিমাপের একটি বড় অংশই আসে বেসরকারি খাতের ভোগ থেকে। তাই প্রবাসী আয় কমতে থাকলে চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা।

এছাড়া প্রবাসীদের হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রবণতা বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতাকেও দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। অবশ্য এ বিষয়ে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরও এক অনুষ্ঠানে স্বীকার করেছেন, প্রবাসীরা সহজেই দেশে অর্থ পাঠাতে হুন্ডির মতো বিভিন্ন মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সে।

রেমিট্যান্স কমার কারণে সার্বিক অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়তে পারে এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসত কিন্তু এখন বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে সে টাকা আসছে।

প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়া, ব্যয় বাড়ার কারণে তারা আগের থেকে দেশে টাকা কম পাঠাচ্ছে। আর গ্রামীণ অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স একটি বড় অবদান রাখত এবং এর ফলে তাদের পরিবারের সদস্যদের সরাসরি ক্রয়ক্ষমতা বাড়াত। এখন কম আসার কারণে তাদের ওপর সরাসরি একটি নেতিবাচক প্রভাবতো পড়ছেই। জীবনযাত্রার মানও কমছে।

আর গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর একটি বিশেষ অবদান ছিল। এর মধ্যে সেবা খাতের চাহিদা দুর্বল হলে গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও উৎপাদনের ওপর প্রভাব পরবে। এছাড়া শহরে রিয়েল এস্টেট খাতে রেমিট্যান্সের একটি অবদান ছিল। অনেক প্রবাসী ফ্ল্যাট কিনে দেশে ফিরে এসে সেখানে থাকেন বা ফ্ল্যাটের দাম বাড়লে পরে বিক্রি করে সেখান থেকে লাভ করেন। সেখানেও কিন্তু একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া কিছু রেমিট্যান্স শেয়ার মার্কেটেও আসা শুরু করেছিল। সেখানেও এর প্রভাব অবশ্যই পড়বে।

তিনি বলেন, এদিকে নন-ফরমালভাবে যে টাকাগুলো আসছে সে থেকে ক্রয়ের ওপর হয়তো কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেললেও ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এ টাকাগুলো এলে এটি ব্যাংক ডিপোজিটে থাকত এবং ডিপোজিট বাড়লে ব্যাংকের পক্ষে ব্যবসা করাটা আরো সহজ হতো। ঋণ কার্যক্রম আরো জোরদার করা যেত। কাজে এই বেনিফিটগুলো কিন্তু আমরা আর পাচ্ছি না।

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে যে তথ্য রয়েছে সে হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এক দশমিক ৬৭ বিলিয়নের কাছাকাছি রেমিট্যান্স কমেছে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ কমেছে মধ্যপ্রাচ্য ও ৪৫ শতাংশ কমেছে অন্যান্য দেশ থেকে।’

রিজার্ভের ওপর কোনো প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে কিনা? এ বিষয়ে তিনি বলেন, অবশ্যই প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকবে এবং একটি চাপ আসতে পারে। তাই আমাদের রিজার্ভ নিয়ে যে তুষ্টি, ‘৩৩ বিলিয়ন রিজার্ভ আছে’ মানেই এই না যে আমরা একেবারে যেখানে খুশি সেখানেই ব্যবহার করতে পারব। তবে সেখানে একটি করণীয় রয়েছে, তা হলো মুদ্রাবিনিময় হারকে বাজারে ছেড়ে দেওয়া। তাহলে যদি রিজার্ভের ওপর চাপ আসে তখন সেটি একটু অবমূল্যায়িত হবে।

প্রসঙ্গত, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) প্রবাসীরা মোট ৭১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এ সময়ে এসেছিল ৮৬৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। সেই হিসাবে প্রবাসী আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ কমেছে।

প্রবাসীদের পাঠানো আয় সব সময় ১০০ কোটি ডলারের বেশি থাকলেও গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তা নেমে আসে যথাক্রমে ৯৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার ও ৯৫ কোটি ৮৭ লাখ ডলারে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে ১১৫ কোটি ৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ২০১৬ সালে প্রবাসীরা ১ হাজার ৩৬১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে এসেছিল ১ হাজার ৫৩২ কোটি ডলার। সে হিসাবে গত বছরে প্রবাসী আয় আগের বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ কমেছিল।

এর আগে ২০১৩ সালেও প্রবাসীরা তার আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ কম রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। প্রবাসী আয়ের নেতিবাচক প্রবণতা প্রথম দেখা দেয় ২০১৩ সালে। আগের বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি ঘটলেও ওই বছর প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঘটে। ওই বছরে প্রবাসীরা ১ হাজার ৩৮৩ কোটি ডলার পাঠান, যা ২০১২ সালের তুলনায় ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ কম ছিল।



মন্তব্য চালু নেই