রোহিঙ্গাদের আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই!

জাতীয় দৈনিকগুলোতে ছবিসহ ব্যানার হেডলাইন ছাপা হচ্ছে, ‘ নাফ নদীতে ভাসছে শত শত রোহিঙ্গা’। এ দুনিয়ায় মনে হয় না এ নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা আছে। পশ্চিমা দুনিয়ায় একটি কুকুর ছানা যদি ড্রেনে পড়ে তো উদ্ধারের জন্যে পুলিশ আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির হয়। টেলিভিশনের ক্যামেরা ক্রুরা ঘটনাস্থলে ছবি তোলার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে । রোহিঙ্গাদের মত বনি আদমরা ক্ষুধার্ত, ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে, জান বাঁচানোর জন্যে নদী ও সাগরে নৌকায় ভাসছে। তারা কি মুসলমান না মানুষ? মুসলিম হোক, হিন্দু হোক, বৌদ্ধ হোক যখন তারা ক্ষুধার্ত ও প্রাণ বাঁচানোর ভয়ে সাগরে ভাসতে থাকে তখন যে কোনো রাষ্ট্র ও মানুষের চেতনা জাগ্রত হওয়ার কথা? রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে কেন হচ্ছে না? কারণ তারা মুসলমান এই জন্যে কি? মুসলিম রাষ্ট্র বা ইসলাম নিয়ে যে সব দেশ অভিভাবকত্ব ফলাতে চান সেসব রাষ্ট্র কি এই মানবিক ইস্যু নিয়ে কিছু করছে? তারা কি মিয়ানমারে সংখ্যালঘু নয়? নাকি সংখ্যালঘু হলেই চলবে না তাকে অমুসলিম হতে হবে??

পাঠক সবিনয়ে বলছি আপনাদের পূর্ব তিমুরের কথা মনে আছে? আরেকটু মনে করার চেষ্টা করলে হয়ত বসনিয়ার ঘটনা মনে হতে পারে। প্রায় একই সময় পূর্ব তিমুর খ্রিস্টান অধ্যুষিত হওয়ায় দুনিয়ার অনেক রাষ্ট্র এগিয়ে এসেছে এর পাশাপাশি বসনিয়ায় মুসলিম নিধন চলেছে।

বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা আসতে চাইলেও তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। ঘনবসতি, সীমিত সম্পদ, স্থান সংকুলানের অভাব, অপরাধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ইত্যাকার কারণ দেখিয়ে বেশ কয়েক লাখ রোহ্ঙ্গিা মুসলমানদের স্থান দিয়ে আর দিতে পারছে না বাংলাদেশ। এ নিয়ে বাংলাদেশ যতটা করেছে এবং বিশ্ববাসীকে বারবার রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে একটা হিস্যা করার জন্যে আবেদনও করেছে তাতে কোনো সাড়া নেই। আর তাই মিয়ানমার সরকার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করার পরও এখনো পূর্বের মত রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। দেশটির সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের ঘটে আগুন দিচ্ছে। নিজেদের ঘরে আগুন দিয়ে সাগরের লোনা জলে ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত রোহিঙ্গারা এই শীতে ভাসছে। এরপরও বিশ্বাস করতে হচ্ছে আধুনিক সভ্য সমাজ মানবাধিকার সচেতন।

তো রোহিঙ্গাদের যখন এই অবস্থা তখন ওআইসি কি করছে? সৌদি আরবের দুটি পবিত্র মসজিদ ও মুসলমানদের অভিভাবক হিসেবে পরিচয়দানকারী দেশটির বাদশাহ কি করছেন? হারাম শরীফের খতিব ড. আব্দুর রহমান সুদাইস কি করছেন? যিনি সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ হাজি হজে গেলে তাদের ঐক্য ধরে রাখার, ধর্ম মেনে চলার উপদেশ দেন তিনি কি কোনো খোঁজ রাখছেন রোহিঙ্গাদের। তার কি কোনো দায়িত্ব নেই রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে। জাতিসংঘ যখন বলছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্যে তখন সৌদি আরব ইয়েমেনে তাবেদার সরকার বসানোর জন্যে তার অস্ত্রগুদাম থেকে মিসাইল ছুড়ছে তখন দেশটির নাগরিক আয়াদ বিন আমিন মাদানি ওআইসি’র মত গুরুত্বপূর্ণ অর্গানাইজেশনের প্রধান। রোহিঙ্গাদের নিয়ে অত্যন্ত মৃদু স্বরে তিনি দুয়েকবার বিবৃতি দিয়েছেন, অংসাং সুকির সমালোচনা করেছেন। ব্যস ওই পর্যন্তই! ৫৭টি দেশের এই প্লাটফরম আর কিছুই করছে না রোহিঙ্গাদের নিয়ে। যদি ৫৭টি দেশ গড়ে ১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের আশ্রয় দেয়ার কথা ঘোষণা করে, মিয়ানমারের ওপর জাতিগত দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধের জন্যে চাপ সৃষ্টি করে, পরাশক্তিগুলোর শরণাপন্ন হয় তাহলেও কিছু আশা করা যেত?

ওইআইসি যে ৫৭টি দেশ সদস্য তার মধ্যে ৫৬টি আবার জাতিসংঘের সদস্য বটে। জাতিসংঘের প্লাটফরমেও রোহিঙ্গাদের হত্যাযজ্ঞ বন্ধে অধিবেশন আহবান করার প্রয়োজন মনে করছে না মুসলিম দেশগুলো। এই হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যের নমুনা।

তাহলে তারা কি করছে? আপনি ইন্টারনেটে আরব নিউজ, খালিজ টাইমস, গালফ নিউজ, সোদি গ্যাজেটের মত বিখ্যাত সব মিডিয়ার অনলাইনের হোমপেজে যান, রোহিঙ্গাদের কোনো খবর পাবেন না। কি পাবেন? উন্নয়নের ফিরিস্তি, শানশওকত, বিলাসিতার মত খবরগুলো। আরব নিউজে আজকের খবর সৌদি বাদশাহ মন্ত্রিসভায় আলেপ্পোতে বোমা হামলার নিন্দা করছেন। তাহলে তার প্রতিবেশি দেশ ইয়েমেনে কে বোমা ফেলছে। বাদশাহ যথারীতি নিরুত্তর।

সটফখালিজ টাইমসে দেখবেন ফিলিপাইন থেকে বিশ্বসুন্দরী মিস ইউনিভার্স পিয়া আলোঞ্জো ওয়াটবেচ দুবাই গিয়েছেন। ইসলামি পোশাক তাকে পড়িয়ে দিচ্ছে আরেক পুরুষ। তা পড়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোজ দিয়ে ছবি তুলে বলেছেন আরবি সংস্কৃতি অনুসরণ করতে তার ভালই লাগছে। পোজ দিচ্ছেন নানা অঙ্গভঙ্গিতেও, সেসব ছবি ছাপা হচ্ছে খালিজ টাইমসে। কিন্তু কোথাও রোহিঙ্গাদের খবর নেই।

ওদিকে প্যারিসের রাস্তায় দুই কাতারি নারীর কাছ থেকে ছিনতাইকারীরা ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার ছিনতাই করে নিয়েছে। রয়েছে সে খবর। দুই নারীর কাছে এত টাকা কেন এ অবান্তর প্রশ্ন না তুলে খালিজ টাইমসে বরং আরেকটি খবরের শিরোনাম দেই। তা হচ্ছে: সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে ধনীদের দেশে পরিণত হয়েছে। এ দুটি দেশের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের কাছে গড়ে ১ লাখ ৬১ হাজার ৭’শ মার্কিন ডলারের সম্পদ রয়েছে। ২০২১ সালে এ অঞ্চলে মিলিয়নারির সংখ্যা ৪ লাখ ৬০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। রয়েছে ইবনে বতুতা শপিং মলের সঙ্গে সংযোজিত হচ্ছে নিউ দুবাই মেট্রো ব্রিজ।

রয়েছে ভারতীয় এক নাগরিক তার নারী সহকর্মীর সামনে অফিসেই প্যান্ট খুলে ফেলেছেন সে খবর। আরেক খবরে বলা হচ্ছে চাকরির নামে জোর করে দেহব্যবসার জন্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিচার চলছে। আরব নিউজের আরেক খবর সৌদি পুলিশ এক ভারতীয় ব্যক্তিকে কাবাশরীফকে হেয় করার জন্যে আটক করেছে। দুবাইতে মটর রেসের জন্যে নতুন ভেন্যু পর্যটকদের নজর কাড়ছে। সৌদি ভিশন ২০৩০’এর লক্ষ্য বর্ণনা করে আরেক খবর বলছে ‘হার্ট অব দি ইসলাম’ হিসেবে দেশটির শহরগুলো সারা দুনিয়া থেকে ব্যাপক পর্যটকের নজর কাড়বে।
আরব নিউজের আরেক খবর, সৌদি আরবের দুই পবিত্র শহর রক্ষায় দেশটির পাশে বাংলাদেশ সবসময় থাকবে। আগামী ১৪ ডিসেম্বর সৌদি বাদশাহ সুরা পরিষদে ভাষণ দেবেন। বুরাইদা শহরে যে ১৩ জন নারী বিক্ষোভ করেছিল তাদের বিচার শুরু হচ্ছে। এমননি নানা খবরের ভীড়ে কোথাও রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের খবর নেই।

ইন্টারনেটে সার্চ দিলে আপনি ‘ঘোস্ট টাউন’ হিসেবে অনেক পরিত্যক্ত অনেক শহরের খোঁজ পাবেন। একসময় উন্নয়নের শিখরে অবস্থান করছিল এসব শহর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পারমানবিক তেজস্ক্রিয়তা, সুনামি, ভূমিকম্প হওয়ায় বা অন্যসব কারণে পরিত্যক্ত শহরগুলোয় ভবন, রাস্তাঘাট, পার্ক, সিনেমা হল, সব স্থাপনাগুলো আগের মত রয়েছে। কোনো রাস্তায় যানজট ছিল, গাড়িগুলো তেমনি রয়েছে, হয়ত ঘাস লতাপাতা গুল্মের ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়েছে। যে উন্নয়ন, যে সম্পদ আর যে বিলাসিতার পাহাড় গড়ে তুলছে মুসলিম বিশ্ব তাতে হয়ত বিশ্ব পর্যটকের নজর কাড়লেও আল্লাহর নজর কাড়বে না। সম্পদের মালিকানা আল্লাহর এ কথা মুসলমানদের অভিভাবক হিসেবে বাদশাহ, রাষ্ট্র ও প্রভাশালীদের মনে রাখার কথা। তাদের এও মনে রাখার কথা রোহিঙ্গা মুসলমানদের আর্তনাদ তাদের কানে না গেলে এর পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে। কারণ তারা এও জানেন, একজন ইহুদি নাগরিক বিশ্বের কোথাও অত্যাচারের শিকার হলে ইসরায়েল কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। তাহলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন, নারী ধর্ষণ আর হত্যাযজ্ঞে মুসলিম বিশ্ব, ওআইসি, হারাম শরীফের অভিভাবকদের নিশ্চুপ করে থাকা কি সাজে!



মন্তব্য চালু নেই