রোহিঙ্গাদের ইতিহাস ও সংকট যেভাবে শুরু

সম্প্রতি সময়ে এশিয়ার সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন। এবারের ঘটনার সূত্রপাত ৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে। ওই দিন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বাংলাদেশ সীমান্ত চৌকির সন্নিকটে মংডু শহরের কাছে প্রায় ৩০০ জন সংগঠিত চরমপন্থির একটি সশস্ত্র দল মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ৯ জন বিজেবি (মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী সেনা) নিহত হয়।

তৃতীয় দিন ১১ অক্টোবর তটমাদৌ অঞ্চলে একই ধরনের হামলায় আরো ৪ বার্মা সেনা নিহত হয়। ধারণা করা করা হয়, হামলাকারীরা রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশান (আরএসও) নামক একটি মুসলিম রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য। এরা নিজেদের ফেইথ মুভমেন্ট অব আরাকানের (এফএমএ) সদস্য হিসেবে পরিচয় প্রদান করছে।

এই হামলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর অভিযান শুরু করে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১৩৪ জন নিহত হয়েছে। যার মধ্যে ৩২ জন সরকারি সেনা এবং ১০২ জন রোহিঙ্গা। এছাড়া ২৩৪ জন রোহিঙ্গা বার্মা সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে। উভয়পক্ষের মধ্যে এখনো বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ যেমন চলছে, তেমনি সেনা অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।

নিরহ রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয়ের চেষ্টা করছে। কিন্তু সীমান্তে নজরদারী বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে প্রবেশের রোহিঙ্গাদের চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। চলুন একনজরে দেখে নেওয়া যায় রোহিঙ্গাদের ইতিহাস ও তাদের সংকট শুরু পটভূমি কি ছিল?

রোহিঙ্গাদের ইতিহাস : ইতিহাসের তথ্য মতে, ৭ম শতাব্দীতে প্রথম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি বার্মায় আসা শুরু করে। প্রথমদিকের এই মাইগ্র্যান্টরা ছিল আরবের নাবিক, ব্যবসায়ী ও যাযাবর, যারা অর্থনৈতিক কারণে এই অঞ্চলে ভ্রমণ করত। এভাবে বার্মার আরাকান অঞ্চলে ৭ম থেকে ১৩শ শতকে, ১৫শ শতকে এবং ১৮২৬ সালের পর থেকে ব্রিটিশ শাসনামলে তিন ধাপে ধীরে ধীরে মুসলিম বসতি স্থাপন শুরু হয়। ১৮৯১ সালের ব্রিটিশ আদমশুমারি অনুযায়ী, আরাকানে তখন মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৫৮,২৫৫ জন, যা ১৯১১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১,৭৮,৬৪৭ জনে।

রোহিঙ্গা সংকট যেভাবে শুরু : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রোহিঙ্গাদের অবস্থান ছিল মিত্র বাহিনীর পক্ষে। ১৯৪২ সালের মধ্য জানুয়ারির দিকে জাপান বার্মা আক্রমণ করে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে শুধুমাত্র বার্মায় জাপানি সেনাদের হাতে অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। তখন প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে চট্টগ্রামে ঢুকেছিল। এছাড়া আরাকানের স্থানীয় রাখাইনদের (বৌদ্ধ মগদের) সঙ্গে এসব উদ্বাস্তু মুসলিম রোহিঙ্গাদের বেশ কিছু দাঙ্গাও হয়েছিল।

১৯৪৬ সালের মে মাসে রাখাইন প্রদেশের মুসলিম রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করেন। তাদের প্রস্তাব ছিল রাখাইন প্রদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করে বুথিডং ও মংদৌ নামে দুটি শহরের একত্রীকরণ। এর দুই মাস পর রোহিঙ্গা মুসলিম নেতৃত্ব আকিয়াবে নর্থ আরাকান মুসলিম লীগ গঠন করে। তখন রোহিঙ্গা মুসলিমরা পাকিস্তানের সঙ্গে আলাদা প্রদেশ হিসেবে বার্মা থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করে।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের এই স্বাধীনতার দাবি ধীরে ধীরে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে যায়। ১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭৮ সালে জেনারেল নে উইন বার্মার রাখাইন প্রদেশে মুসলিম সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের দমন করতে ‘অপারেশন কিং ড্রাগন’ পরিচালনা করে। সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু ভিক্টোরিয়া পাহাড়ের কারণে মিয়ানমারের মূল কেন্দ্র থেকে উত্তর-পশ্চিমের রাখাইন প্রদেশ বা আরাকান অঞ্চল কিছুটা বিচ্ছিন্ন। এই সুযোগটি ব্যবহার করছে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলো।

বাংলাদেশ কীভাবে রোহিঙ্গা সংকটে জড়াল : ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৮ সালে সামরিক জিয়ার সরকার মুসলিম বিশ্বে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সামরিক সরকারের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাবে বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়। বার্মা থেকে পালিয়ে আসা দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা তখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

এই রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার ও উখিয়ায় উদ্বাস্তু হিসেবে জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশন সহযোগিতা করতে শুরু করে। এরপর ১৯৯১-৯২ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের আধা-সামরিক বাহিনী নাসাকা এবং অন্য সম্প্রদায়ের সম্মিলিত আক্রমণের পর নতুন করে আবার প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

পরবর্তীকালে মাত্র এক থেকে দেড় লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমারে ফেরত যায়। কিন্তু বাংলাদেশে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের স্বল্পসংখ্যক জাতিসংঘের নির্ধারিত শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করলেও বেশিরভাগই কক্সবাজার, টেকনাফ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করতে থাকে। অবাক করার বিষয় হলো, বাংলাদেশে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে বলে জাতিসংঘ স্বীকার করে।

অথচ কক্সবাজারের স্থানীয়দের মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৪ থেকে ৫ লাখের বেশি। বাস্তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বর্তমানে ৭ লাখেরও বেশি। ফলে ১৯৭৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুটি কেবল বার্মা বা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ইস্যু ছিল। ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য গোদের উপর বিষফোড়ার মতো একটি নতুন সমস্যা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই