লন্ডনে রোগী, ‘হার্ট বিট’ মাপা যাবে কলকাতায়!

স্টেথোস্কোপ তো নয়, যেন টেলিস্কোপ! এত দূর দেখা যায়। যা পৃথিবীর এক মেরু থেকে অন্য মেরুতে থাকা কোনও মানুষের হৃদপিন্ডের নড়ন-চড়ন বা ‘হার্ট বিট’-এর কম্পাঙ্ক মাপতে পারবে। আর, তার ভিত্তিতেই অঙ্ক কষে বলে দেওয়া যাবে, কারও নাড়ির গতি ঠিকঠাক রয়েছে কি না। না-থাকলে কার্যত, আলোর গতিতেই বলে দেওয়া যাবে তাকে কখন-কী ওষুধ খেতে হবে।

কয়েক হাজার কিলোমিটার লম্বা ‘স্টেথোস্কোপ’ বানিয়ে ফেলেছেন বানিয়ে ফেলেছেন কলকাতার এক বিশিষ্ট চিকিৎসক! সুমেরু থেকে কুমেরু। কলকাতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া। পৈলান থেকে পেনসিলভানিয়া। রোগীর নাড়ি টেপা যাবে এই যন্ত্রে। আর একই সঙ্গে, অস্‌লো, অকল্যান্ড, অন্টারিও বা, ক্যালিফোর্নিয়া, ক্যানবেরা, ক্রেমলিনের রোগী দেখা যাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে, ‘ভিডিও কনফারেন্সিং’-এর মাধ্যমে।

জুল ভার্নের কল্পবিজ্ঞানের গল্প একশো বছর পর সত্যি হয়েছিল। ১৯৬৯-এ প্রথম চাঁদে হেঁটেছিলেন নিল আর্মস্ট্রং। তবে কলকাতার এই নেফ্রোলজিস্টের সদ্য-উদ্ভাবিত এই স্টেথোস্কোপের কথা ভেবে কল্পবিজ্ঞানের কোনও গল্প লেখা হয়েছে, এমন তথ্য অন্তত এই প্রতিবেদকের কাছে নেই!

এই নতুন যন্ত্রটির মূল কার্যকরী অংশ দু’টি। তার একটি হল, বহু দূরের কোনও রোগীর ‘কেস হিস্ট্রি’ শোনা ও তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার জন্য ‘ভিডিও কনফারেন্সিং’ চালাতে যা জরুরি, সেই ‘স্পাইক ডিভাইস’। অন্যটি রোগীর হৃদপিণ্ডের নড়ন-চড়নের শব্দের কম্পাঙ্ক মাপার জন্য জরুরি ‘সাউন্ড গেটিং সিস্টেম’ বা, এসজিএস। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের নবতম শাখা-‘রোবটিক মেডিসিন’কে এ দেশে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এই যন্ত্রটি বানিয়েছেন কলকাতার বিশিষ্ট নেফ্রোলজিস্ট প্রতীম সেনগুপ্ত। ‘মাল্টি-স্পট ভিডিও কনফারেন্সিং’ সফ্‌টওয়্যারটির জন্ম দিতে প্রতীমবাবুকে সাহায্য করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সুজয় চক্রবর্তী। এ ছাড়াও, তাকে সাহায্য করেছেন এমআইটি-র গবেষক সোমক চৌধুরী ও সফ্‌টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সপ্তর্ষি রায়চৌধুরী।

এই নতুন যন্ত্র ও আনুষঙ্গিক সফ্‌টওয়্যারটির কার্যকরী ক্ষমতা ও সাফল্য সম্পর্কে তিনি কতটা নিশ্চিত?
প্রতীমবাবুর দাবি, ‘২০০ শতাংশ। এর মধ্যেই কম করে জনাপঞ্চাশেক রোগীর ক্ষেত্রে এই যন্ত্রের ব্যবহার পুরোপুরি সফল হয়েছে।’

কীভাবে কাজ করবে যন্ত্রটি?
প্রতীমবাবুর ব্যাখ্যা, ‘আমাদের ‘হার্ট বিটে’র অনেক রকম শব্দ হয়। সেই শব্দের কম্পাঙ্কও হয় বিভিন্ন মাত্রার। যা শুনে, সেই সব ‘অডিটারি ইনপুট’ দিয়ে রোগীদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয় চিকিৎসকদের। স্টেথোস্কোপের এই পদ্ধতিকেই আরও নিখুঁত করে তুলতে নতুন যন্ত্রটির ‘সাউন্ড গেটিং সিস্টেম’ ‘হার্ট বিটে’র বিভিন্ন মাত্রার শব্দের মধ্যে মূলত, তিনটি কম্পাঙ্ককে বেছে নেয়। তার পর সেই তিনটি কম্পাঙ্কের গড় হিসাব করে একটি জটিল গাণিতিক পদ্ধতিতে।’

কিন্তু, রোগীদের সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেতে তো চিকিৎসকদের ‘ভিস্যুয়াল ইনপুট’-এরও দরকার হয়। সেই চাহিদা মিটবে কীভাবে?
প্রতীমবাবু জানাচ্ছেন, ‘এর জন্যই ‘মাল্টি-স্পট ভিডিও কনফারেন্সিং’র ব্যবস্থা। তা চালানোর জন্য বানানো হয়েছে আলাদা সফ্‌টওয়্যারও। যন্ত্রের দ্বিতীয় অংশ-‘স্পাইক ডিভাইস’ এই কাজেই সাহায্য করবে। এ দেশে, শহর থেকে দূরবর্তী এলাকায়, জেলাগুলির প্রত্যন্ত অঞ্চলে, পাহাড় বা, সমুদ্র-লাগোয়া দুর্গম এলাকাগুলিতে ‘হাই-স্পিড ইন্টারনেটে’র সুযোগ-সুবিধা এখনও পৌঁছয়নি বললেই চলে। যাতে ওই সব এলাকার রোগীকেও কলকাত বা, ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে দেখতে পারেন চিকিৎসকেরা, তার জন্য এই ‘স্পাইক ডিভাইস’-ই ইন্টারনেটের ‘টু-জি স্পিড’-কে বদলে দেবে ‘থ্রি বা, ফোর-জি স্পিডে’।’

চিকিৎসকদের আর যেটা লাগে, তা হল-‘ট্যাকটিক্যাল ইনপুট’। মানে, রোগীকে স্পর্শ বা ‘টাচ’ করে তার শরীরের হাল-হকিকৎ বোঝার চেষ্টা। নতুন যন্ত্রে সেটা কি সম্ভব?
প্রতীমবাবুর দাবি, ‘সেই প্রযুক্তিও আমাদের নাগালে। কিন্তু, প্রচুর খরচের জন্য নতুন যন্ত্রটিতে এর ব্যবস্থা নেই। পরে তা-ও থাকবে।’

চিকিৎসায় এই ‘ইনটিগ্রেটেড ইনফো-টেক’ ব্যবহারের ভাবনা কীভাবে তার মাথায় এল?
প্রতীমবাবু জানাচ্ছেন, চিনে ‘রোবটিক মেডিসিন’ নিয়ে তিনি একটি ওয়ার্কশপে গিয়েছিলেন ২০০৮-এ। সেখানেই লি হুইয়ের মতো বিখ্যাত গবেষকের সঙ্গে তার আলাপ হয়। ‘রোবটিক মেডিসিন’ নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা করছেন লি। এই যন্ত্র বানানোর কথা তখনই মাথায় আসে তার। শেষমেশ কাজটা শুরু করেন ২০১১ সালে।



মন্তব্য চালু নেই