শশাঙ্ক মনোহরই হচ্ছেন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট!

পশ্চিমবঙ্গ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (সিএবি) সভাপতি নির্বাচনের পদ্ধতিটা নিয়ে এখনও চলছে তোলপাড়। নোংরা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সৌরভ গাঙ্গুলির প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন পাওয়াটা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এরই মধ্যে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট পদেও প্রায় একই পন্থায় নতুন ব্যাক্তিকে বেছে নেয়া হলো। নতুন করে যাকে বেছে নেওয়া হলো, তিনি আসলে নতুন নন। সাবেক বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট শশাঙ্ক মনোহর। ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।

জগমোহন ডালমিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর মতোই আকস্মিক তার উত্তরাধিকার! যেমন রাজ্য ক্রিকেটে, তেমনই ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেটে। শশাঙ্ক মনোহরের শুভানুধ্যায়ীরা শনিবার রাতে বলছিলেন, বিসিসিআই খুব বিপজ্জনক জায়গা। যে কোনও কিছু যে কোনও সময় ঘটতে পারে। দোহাই এখনই শশাঙ্কের নাম চূড়ান্ত বলে লিখে দেবেন না। শশাঙ্ক নিজেও এই মুহূর্তে মুখ খুলতে ইচ্ছুক নন।

তবে ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিসিসিআইর অন্যতম নিয়ন্ত্রক অরুন জেটলির অনুরোধেই ঢেঁকি গিলতে হচ্ছে শশাঙ্ক মনোহরকে। এই অরুণ জেটলি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যতই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সামলান না কেন, যতই উপ-প্রধানমন্ত্রীসুলভ ব্যস্ততা তার থাকুক না কেন, ভারতীয় ক্রিকেটের রিমোট কন্ট্রোল এখনও তারই হাতে। এখনও জেটলি যা বলেন তা-ই হয়। ক্ষমতার লড়ালড়িতে তিনিই চূড়ান্ত নির্ণায়ক।

এমনই জেটলি বৃহস্পতিবার রাতে নিজের বাড়িতে বসে শশাঙ্ককে বলেন, ‘আমি চাই আপনি ভারতীয় বোর্ডের হাল ধরুন। এই কঠিন সময়ে আপনাকেই দরকার।’ সে সময় সেখানে ছিলেন সাবেক বোর্ড কোষাধ্যক্ষ অজয় শিরকে এবং বোর্ড সচিব অনুরাগ ঠাকুর। শিরকে তখন বলেন, ‘শশাঙ্ক, তোমার কিন্তু ‘না’ করা উচিত নয়।’

বৃহস্পতিবার অরুন জেটলির বাড়িতে রাতের বৈঠকে উপস্থিত থাকা এরা সবাই একমত হন যে, ডালমিয়া অনেক কিছু সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। যা আধুনিক সময়ে ক্রিকেট বোর্ডের বিশেষ প্রয়োজন। বিশেষ করে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন নানান বিশৃঙ্খলা তৈরি করে যাওয়ার পর তো আরও প্রয়োজন; কিন্তু যাবতীয় ইচ্ছে থেকেও ডালমিয়া সেই সংস্কারগুলো করতে পারেননি স্রেফ শেষ দিকের ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে। জেটলি বলতে থাকেন, শশাঙ্ক এই পদ নিলে বোর্ড নতুন গরিমা পাবে। আর ডালমিয়ার ইচ্ছেগুলোও মর্যাদা পাবে।

শশাঙ্ক এক কথায় রাজি হননি। শেষ যেবার বোর্ড প্রেসিডেন্ট ছিলেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বলে গিয়েছিলেন, ‘আর কখনও বোর্ডের ত্রিসীমানাতেই আসব না।’ সৎ এবং বলিষ্ঠ প্রশাসক হিসেবে তিনি এতটাই পরিচিত যে, তার এই বয়ানকে কেউ ফাঁকা গুলি হিসেবে ভাবেনি। এদিনও তিনি বলেন যে, ‘আমি পাঁচ বছর বোর্ড থেকে একেবারে দূরে। কী হচ্ছে না হচ্ছে দৈনন্দিন কিছুই জানি না। ওপর-ওপর জানি। এত দিন দূরে সরে থেকে দুম করে বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঠিক করে চালাতে পারব কি না, সেটা নিয়ে আমাকে একটু ভাবতে হবে।’

এই কথাকে কেউ নাটক হিসেবে ধরেনি। বাকিদের পীড়াপীড়ির পর শশাঙ্ক বলেন, আমার সময় চাই। আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা দিন। তখন অনুরাগ ঠাকুর বলতে থাকেন, ‘অরুণজি ওনাকে একদম সময় দেবেন না। এখনই ওনাকে রাজি হতে বলুন।’ জেটলি বলেন, ‘ঠিক আছে। তিনি যখন চাইছেন, তখন সময় দেওয়া হোক।’

এরপরেও মনোহর কিছুটা বিব্রত ছিলেন, যেহেতু তার গোষ্ঠীরই শারদ পাওয়ার বারবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। তার আগ বাড়িয়ে নাম আসাটা লজ্জাকর হচ্ছিল। শশাঙ্ক এমন একটা অবস্থায় সাইডলাইন থেকে আচমকা উঠে এলেন, যেখানে ডালমিয়ার ফেলে যাওয়া মুকুটের জন্য তিন জন প্রতিদ্বন্দ্বী। তিন জনই স্টার্টিং ব্লকে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। তারা হলেন- শারদ পাওয়ার, রাজীব শুক্লা এবং অমিতাভ চৌধুরি।

রাজীব এদের মধ্যে মুকুটের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। শোনা যাচ্ছিল জেটলির স্নেহধন্য হিসেবে তিনিই বসে যেতে পারেন বোর্ড প্রেসিডেন্টের চেয়ারে; কিন্তু রাজীবের সমস্যা হচ্ছিল, তিনি পাওয়ার গোষ্ঠীর ভোটগুলো জোগাড় করতে পারছিলেন না। পাওয়ার— তিনি গোটা ন’দশেক ভোট জোগাড় করে ফেলেছিলেন। কিন্তু জেটলির সম্মতি না পাওয়ায় বিজেপি-ভোটের দরজা তার সামনে খুলছিল না।

আর ঝাড়খণ্ড ক্রিকেট সংস্থার প্রধান অমিতাভ চৌধুরি ছিলেন বকলমে শ্রীনির প্রার্থী। অমিতাভ চাইছিলেন ট্যাকটিক্যালি ম্যাচ জিততে। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে, যাতে পূর্বাঞ্চলের ছ’টা রাজ্য থেকে প্রস্তাব তোলা এবং সমর্থন করার লোক না পান পাওয়ার-শুক্লারা। অমিতাভ বলেছিলেন, ‘কেন পূর্বাঞ্চলের লোক পূর্বাঞ্চলের ফেলে যাওয়া পদ পূর্ণ করবে না? তার মানে কি আমরা ধরে নেব গোটা পূর্বাঞ্চলে প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য লোকই নেই?’

কিন্তু এই আবেগে বাকি ক্রিকেট-ভারতকে তিনি প্রভাবিত করতে পারেননি। বোর্ডে এই মুহূর্তে যা হাওয়া, তাতে শ্রীনির পছন্দের কোনও প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা আসা খুবই কঠিন। পাওয়ারকেও গতকাল শিরকে গিয়ে বলে আসেন, ‘আপনি দাঁড়ালে নির্বাচন হবে। আপনার সমর্থনে বিজেপির ভোট আমরা এখনও দেখতে পাচ্ছি না। সে ক্ষেত্রে শশাঙ্কই বোধহয় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য।’ পাওয়ার সেই যুক্তি মেনে নেন, যতই তার কাছে তা অপ্রিয় হোক। শ্রীনির সঙ্গে বৈঠক করে তিনি নিজের ভোট আর শ্রীনির ভোট জড়ো করেছিলেন; কিন্তু বিজেপির ভোট না পেলে যে নির্বাচন জেতা অনিশ্চিত, সেটা পওয়ার খুব ভালই জানেন। আর রাজীব শুক্লাকে অর্ধেক লোকই বিশ্বাস করেন না।

সুতরাং সাইডলাইনে বসে থাকা শশাঙ্কই হয়ে যান সকলের গ্রহণযোগ্য প্রার্থী। এমন কেউ, যিনি দাঁড়ালে নির্বাচন হওয়ার আশঙ্কা নেই। এ দিকে ‘আমি রাজি আছি’— এটা বলার জন্য শশাঙ্ক শনিবার অরুণ জেটলিকে ফোনও করেছিলেন। কিন্তু তার ফোন বেজে যায়। শশাঙ্কের ধারণা হয় তখন জেটলি ডালমিয়ার বাড়িতে আছেন, তাই ফোন ধরতে পারছেন না। তিনি অজয় শিরকেকে বলে দেন, ‘অরুণজিকে বলে দেবেন আমি রাজি।’

ওই সময়ই আলিপুর রোডের বাড়িতে বসে অভিষেক ডালমিয়া বলছিলেন জেটলিকে, ‘মনোহরের প্রতি আমাদের পুরো সমর্থন আছে। আর যে-ই হোক, শ্রীনি কিছুতেই নয়।’ অভিষেককে খুব পছন্দ করেন জেটলি। তিনি আশ্বাস দেন, ডালমিয়া পরিবারের আবেগ মাথায় রাখা হবে।

আগামী ৪ অক্টোবরের মধ্যে বোর্ডের বিশেষ সাধারণ সভা ডাকা হবে। সেই সভাই শশাঙ্কের মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে। তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী রাজীব শুক্লা এর মধ্যেই ফোনে সম্ভাব্য বোর্ড প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দিয়েছেন, শশাঙ্ক দাঁড়ালে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। বরং তাকে সব রকম সাহায্য জানাতে রাজি আছেন।

শশাঙ্কের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার কাছাকাছি সময় ইডেনে সিএবির বিশেষ সাধারণ সভা বসার কথা। যেখানে আবার সৌরভ গাঙ্গুলির নাম প্রেসিডেন্ট হিসেবে চূড়ান্ত হবে। সৌরভকে খুব পছন্দ করেন মনোহর। সৌরভ যখন ভারতীয় কোচ হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন তখন মনোহর বলেছিলেন, ‘ওর কি মাথা খারাপ নাকি? ও কেন ভাবছে না যে, আমি বোর্ড প্রশাসনে এমন জায়গায় যাব যেখানে আমি নিজে কোচ ঠিক করব। কোচ হব না।’’

পূর্বাঞ্চল থেকে সৌরভের সিএবিই যদি শশাঙ্কের নাম প্রস্তাব করে, তাহলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। ডালমিয়া তখন ওপরে বসে নির্ঘাত স্বস্তিতে থাকবেন যে, বাংলা আর ভারতীয় ক্রিকেট একই লাইনে চলছে।

আর শ্রীনি? তাঁর কী হবে? তিনি কি আইসিসিতে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে যেতে পারবেন সেপ্টেম্বরে? অনেকেই মনে করছেন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে তাঁর মনোনয়ন খারিজ করে চরমপন্থী শশাঙ্ক যাবেন আইসিসি বৈঠকে। এরপর শনিবার রাতে শশাঙ্ক সাংবাদিকদের বললেন, ‘উফ আপনারা পারেন বটে! একটা জিনিস ঘটতে না ঘটতেই পরেরটা!’



মন্তব্য চালু নেই