শিকারের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ অপর্যাপ্ত : ২০ বছরেই হারিয়ে যাবে ইলিশ!

পটুয়াখালী: কিছুদিন পরেই নদী ও সাগরে ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে। ওই সময়ে ডিম ছাড়বে ইলিশ। কিন্তু সে সময়ের আগেই সাগরের নোনা পানি থেকে নদীর মিঠা পানিতে তেড়ে আসা ডিমওয়ালা মা ইলিশ শিকার ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। প্রতিবছর এভাবেই ব্যাহত হচ্ছে ইলিশের প্রজনন। এর ফলে কমছে ইলিশের উৎপাদন।

এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন ইলিশের প্রজননের জন্য সরকারের নিষেধাজ্ঞার মওসুম পর্যাপ্ত নয়। মওসুমের ব্যাপ্তি আরো বাড়ানো প্রয়োজন।

২০ বছর আগের তুলনায় ইলিশের উৎপাদন ৮০ শতাংশ কমে গেছে বলে মনে করছেন মৎস ব্যবসায়ীরা। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, রেনু ও জাটকা সংরক্ষণে আরো কঠোর কিংবা প্রজনন কালীন নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানো না হলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ পুরোপুরিই হারিয়ে যাবে।

উত্তর বঙ্গোপসাগরের সাথে মিশেছে পটুয়াখালীর তেঁতুলিয়া, পায়রা ও রামনাবাদ নদী। এর সাথে যুক্ত আছে লোহালিয়া নদী। সাগর তীরবর্তী এ নদীগুলোতে বর্ষা মওসুমে প্রজননের সময় ডিম ছাড়তে খুব সহজে নোনা পানি থেকে তেড়ে আসে মা ইলিশ। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এ দুমাস ঝাঁকে ঝাঁকে মা ইলিশ আসে ডিম ছাড়তে। তখন ওইসব নদীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পেতে রাখা জেলেদের জালে ধরা পড়ে ডিমওয়ালা মা ইলিশ। প্রজনন করতে না পারায় প্রতি বছর ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে ইলিশ। এ কারণে ২০ বছর আগের তুলনায় ইলিশের উৎপাদন ৮০ শতাংশ কমে গেছে বলে ধারণা করছেনমাছ ব্যবসায়ীসহ জেলেরা।

সূত্রমতে, ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরকার কয়েক বছর থেকে উৎপাদন বৃদ্ধিসহ প্রজনন নিরাপদ করতে বছরের নির্ধারিত ১০ দিন মা ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জেলেরা ইলিশ শিকার করছেই। তবে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ১০দিন যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি বছর ওই মেয়াদ ১০ দিন বাড়িয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ১৫ দিন করেছে সরকার। কিন্তু ওই মওসুম আসার আগেই নিধন হচ্ছে ডিমওয়ালা মা ইলিশ।

সরেজমিনে চলতি ১৪ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর তেঁতুলিয়া নদীর তীরবর্তী বাঁশবাড়িয়া, বহরমপুর, বগি, শৌলা, নাজিরপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে জেলেদের জালে ধরা পড়া ইলিশের সিংহভাগই মা। এরমধ্যে ছোট-বড় ১০টি ইলিশ কেটে দেখা গেছে প্রত্যেকটির পেটে ডিম। ফলে নিরাপদ প্রজননের জন্য সরকারের ১০ কিংবা ১৫ দিন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিপুল পরিমাণ মা ইলিশ ডিম ছাড়তে সাগর থেকে পটুয়াখালীর তেঁতুলিয়া, লোহালিয়া, রামনাবাদ, পায়রা নদীর মিঠা পানিতে আসে। নদীতে আসার পর ডিম পরিপক্ক হলে একটি বড় ইলিশ একবারে ২০ লাখ এবং ছোট ইলিশ ৫ থেকে ১০ লাখ রেনু দেয়। তাতে ইলিশের রেনুতে সয়লাব হয়ে যাওয়ার কথা নদীগুলোর পানি। কিন্তু তা হচ্ছে না। ঝাঁকে ঝাঁকে ডিমওয়ালা মা ইলিশ শিকারের ফলে উৎপাদন ক্রমশ কমে যাচ্ছে। নিরাপদ প্রজনন ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ব্যাপক ভাবে গণসচেতনতা, সমাজিক আন্দোলন, জেলেদের পুনর্বাসন, রাজনৈতিক নেতাদের শতভাগ সহযোগিতা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি মা ইলিশ শিকারে ১০ থেকে ১৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে এক মাস করা উচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, আরো ভালো হয় যদি ডিমওয়ালা মা ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ দুমাস করা যায়। মৎস বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ইলিশের রেনুকে নিরাপদে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়া না হলে আগামী ১০ বা ১৫ বছরের মধ্যে দুষ্প্রাপ্ত হয়ে যাবে ইলিশ।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, সময় উপযোগী ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার ইলিশ উৎপাদন সম্ভব।

এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন তেঁতুলিয়া পাড়ের প্রত্যেক ছোট আড়তদার ১০ থেকে ১৫ মণ আর বড় আড়তদার ২০ থেকে ৩০ মণ ইলিশ কিনে থাকে জেলেদের কাছ থেকে। যার মধ্যে অধিকাংশই ডিমওয়ালা মা ইলিশ।
কালাইয়া এলাকার আড়তদার অমর দাস বলেন, ‘এখন ইলিশের পেটে ডিম পাওয়া যাচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা না থাকার কারণে এসব মাছ ধরা পড়ছে। ডিম ছাড়তে পাড়লে ওইগুলোই এক সময় বড় ইলিশ হতো।’

কুয়াকাটা আলিপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আনছার উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘ইলিশ কমে গেছে। অতীতের বছরগুলোতে কুয়াকাটা সংলগ্ন সাগরে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ টন ইলিশ ধরা পড়ত। এ বছর মাত্র এক থেকে দুই টন ধরা পড়ছে। কারণ মা ইলিশ শিকার করায় এমনটি হয়েছে। ইলিশ রক্ষা করতে হলে মা ইলিশকে বাঁচাতে হবে। পাশাপাশি ভারতীয় জেলেদের আগ্রাসন পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। এ জন্য সরকারের পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। তা না হলে পাঁচ বছরের মধ্যে ইলিশ হারিয়ে যাবে।’

বাউফল উপজেলার শৌলা এলাকার জেলে সফিক হাওলাদার বলেন, ‘এ্যাহন সব মাছের প্যাডে ডিম। এই সময় সাগরের তোন যত মাছ নদীতে আয় বেশিরভাগ ইলিশের প্যাডে ডিম ভরা থাহে। এই মাছের দামও ভাল। আমরা প্যাডের টানে ধরি। সরকার আমাগো মোত আসল জাইল্লাগোরে ঠিক মোত সাহায্য করলে জাইল্লারা মাছ ধরতে না।’

এ ব্যাপারে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস বিজ্ঞান অনুষদের একুয়া কালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ইলিশ কমে যাচ্ছে আমাদের কারণে। ইলিশ রক্ষায় আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সচেতন হওয়া উচিত। এজন্য ইলিশ শিকারে নীতিমালা, রক্ষণাবেক্ষণ, বছরের নির্ধারিত একটি সময়ে প্রজননের জন্য কাজ না করে সারা বছর গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। রেনু ও জাটকা সংরক্ষণে আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই সহযোগিতা করতে হবে। প্রজনন কালীন নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন। আর এগুলো সব কিছুই একটি নীতিমালায় নিয়ে আসা উচিত। তবেই ইলিশ রক্ষা হবে, নয়তো ইলিশ ২০ বছরের মধ্যে পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।’



মন্তব্য চালু নেই