শিক্ষায় দরিদ্র নয় বাংলাদেশ

দেশের শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন এমন ব্যক্তি মাত্রই জানেন, ইএফএ বা ডাকার ঘোষণা অথবা ইউএন মিলেনিয়াম ডিক্লারেশন বা এমডিজিস এ স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নিশ্চিতকরণ ও দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সফল ভাবেই নানান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলছে সফলতার সঙ্গেই।

আর যারা পত্রিকায় দু’একটা সংবাদ শিরোনাম দেখে শিক্ষা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন তাদের কথা অবশ্য ভিন্ন।

২০১০ সালে প্রণয়ন হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হার সরকারিভাবে ৯৯ শতাংশ বলা হলেও আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে ৯৭.৩ শতাংশ। সরকারের পরিসংখ্যান গ্রহণ না করলেও ৯৭.৩ শতাংশ সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতোই ঘটনা। নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার তিন বছর আগে অর্জিত হয়েছে এমডিজি’র বেশ কয়েকটি দিক। এর মধ্যে অন্যতম ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শিক্ষায় সমতা অর্জন। ৯৬.২ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী স্কুলে যায়। আর মেয়েদের যাওয়ার হার ৯৮.৪ শতাংশ।

২০১৫ সালেই শেষ হয়ে গেছে সবার জন্য শিক্ষা এবং এমডিজিস এর সময়সীমা। ওই বছরের মে মাসে কোরিয়ার ইনচনে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলন। বাংলাদেশ যে কতোটা এগিয়েছে সেটা বোঝা গেছে সেই সম্মেলনের আলোচনা থেকেই।

২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষায় নানা টার্গেট দেওয়া হয় ইনচন সম্মেলনে। ১৪০টি দেশের শিক্ষামন্ত্রীরা অবাক হয়ে গেছেন যখন তারা জেনেছেন; বাংলাদেশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই দিচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, শিশু শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা চার কোটি। যা অনেক অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়ে শুধু বেশিই নয় দ্বিগুণ।

এতো শিশুকে বই দিয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, অর্থনৈতিক ভাবে ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা তেল বেচে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাওয়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো ধনী না হলেও শিক্ষায় এদেশ ওইসব দেশের চেয়ে অনেক অনেক ধনী। মান নিয়ে বির্তক আছে থাকবে, কিন্তু বই বিতরণের এই অর্জনকে ‘শিক্ষায় মান’ এর দোহাই দিয়ে যারা ছোট করতে চান তারা আসলে ভালোকে ভালো বলতে একদমই রাজি নয়। ভিন্নদের কথাও ভিন্ন।

বিশ্বে নানা ধরনের দিবস পালিত হয় বছরজুড়েই। বাংলাদেশও এর থেকে পিছিয়ে নেই। কিন্তু বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি দিবস ঘোষণা করে। সে দিবসটি হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবস। ২০১০ সাল থেকে ১ জানুয়ারি দিবসটি পালিত হয়ে আসছে উৎসবের মধ্য দিয়ে।

২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি শুক্রবার হলেও শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অনুরোধে নির্দিষ্ট দিনেই জাতীয় অনুষ্ঠান করেছে মন্ত্রণালয়। বছরের প্রথম দিন দেশের সব প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, এবতেদায়ী, মাধ্যমিক স্কুল, দাখিল মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৪ কোটি ৪৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৭২৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মোট ৩৩ কোটি ৩৭ লক্ষ ৬২ হাজার ৭৭২টি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেছে সরকার।

২০১০ থেকে ২০১৬ এই ৭ বছরের পরিসংখ্যান যদি তুলে ধরি তাহলে দাঁড়ায় এই সময়ে বছরের প্রথম দিন সরকার ২৬ কোটি ২ লক্ষ ২১ হাজার ৮৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৮৯ কোটি ২১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮৯৫টি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে পৌঁছে দিয়ে সারা বিশ্বেই এক অনন্য রেকর্ড করেছে। সরকারি ভাবে এতো বই ছাপিয়ে বাঁধাই করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থীর হাতে বছরের প্রথম দিনে বিতরণের নজির বিশ্বের কোথাও নেই।

এতোগুলো বই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ছাপা, বাঁধাই, পৌঁছে দেওয়া এবং সব শেষে বিতরণ সত্যিই চ্যালেঞ্জের বিষয়। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাদের নূন্যতম যোগাযোগ নেই তাদের পক্ষে এটা বোঝা সত্যিই অসম্ভব।

যদি ২০১৬ শিক্ষা বর্ষের কথাই ধরি এবং নানা খুঁটিনাটি বিষয় বলি তাহলে অবাক হতেই হবে। এবার বই ছাপতে কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে ৮৫ হাজার ৮০৯ মেট্রিক টন। পরিবহণ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার ট্রাক। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ছিল ২৮৬টি। বিভিন্ন পর্যায়ের জনবল ছিল ২১ হাজার। আর পরিবহণে কর্মী নিয়োজিত ছিল ৯৯ হাজার।

প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ করা হয়েছে ৬৫ লক্ষ ৭৭ হাজার ১৫৪টি। প্রাথমিকের বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীদের জন্য ৩৩টি বিষয়ের, এবতেদায়ী ৩৬ বিষয়ের, মাধ্যমিকের বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের জন্য ১১৪টি বিষয়ের, এসএসসি ভোকেশনালের শিক্ষার্থীদের জন্য ১৮টি বিষয়ের এবং দাখিল ও দাখিল ভোকেশনালের শিক্ষার্থীদের জন্য ৮৮টি বিষয়ের বই বিতরণ করা হয়।

এখানেই কার্যক্রম শেষ নয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যবই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওয়েবসাইটে ই-বুক ফর্মে দেয়া আছে। www.nctb.gov.bd ও www.ebook.gov.bd এই ঠিকানা থেকে যে কোন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও গবেষকরা ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ সুবিধা বঞ্চিত শিশু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরাও পেয়েছে তাদের ভাষার বই। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।

প্রতিবেশী রাষ্ট ভারত এবং পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে এমডিজি’র বেশ কয়েকটি বিষয়ে বাংলাদেশের যে অর্জন তা কি করে সম্ভব হয়েছে? শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে, বিশেষ করে বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে যাওয়াতে শিক্ষার প্রতি সবার আগ্রহ বেড়েছে। শিক্ষায় আগ্রহ বেড়েছে বলেই নারীদের শিক্ষায় আসার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। কমেছে বাল্য বিবাহ। পুষ্টি বৃদ্ধি ও মাতৃমৃত্যুর হার কমার পেছনেও কাজ করেছে শিক্ষা।

শিক্ষায় এতো বিনিয়োগের পরেও অবশ্য একটি কথা বলতে হচ্ছে যে, শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ কিন্তু গত কয়েক বছরের তুলনায় কমেছে। ইনচন ঘোষণায় কিন্তু বাংলাদেশের এই ব্যর্থতার কথা তুলেও ধরা হয়েছে।

২০০০ সালে সেনেগালের রাজধানী ডকারে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ডাকার ঘোষণায় স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৬ শতাংশ বা জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবন্ধ।

এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি কোনো সরকার। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এমনকি নেপালও এদিক দিয়ে আমাদের থেকে এগিয়ে রয়েছে। যদি সত্যিই বাংলাদেশ ওই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারতো, তাহলে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছা হয়তো এখনই সম্ভব ছিল।-চ্যানেল আই

লেখক:মোস্তফা মল্লিক



মন্তব্য চালু নেই