শিবিরের মেসে বোমার কারখানা

ইসলামি ছাত্রশিবির নিয়ন্ত্রিত কয়েকশ’ মেসেই তৈরি হচ্ছে নাশকতার বোমা। চলমান হরতাল অবরোধের মধ্যে নাশকতা চালাতে শিবির কর্মীরা নিজেদের তৈরি এসব বোমা ব্যবহার করছে।

সম্প্রতি রাজধানীর মহাখালী এলাকার একটি মেস থেকে গ্রেপ্তার হওয়া বনানী থানা শিবিরের সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমানসহ তার সহকর্মীদের স্বীকারোক্তিতে এমন তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

এ ছাড়া রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সাতক্ষিরা ও কুষ্টিয়ার শিবির চালিত বেশ কয়েকটি মেসে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বোমার সরঞ্জাম উদ্ধার হয়। গ্রেপ্তার হয় শিবিরের বেশ কিছু নেতাকর্মী। তারা র‌্যাবকে অবরোধ নাশকতার ছক সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে।

শিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাশকতামূলক পরিস্থিতির জন্য বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের একটি অংশসহ জামায়াত-শিবিরেরও একটি বড় অংশ জড়িত রয়েছে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী চোরাগোপ্তা হামলা বাস্তবায়নের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে একটি মহল।

জানতে চাইলে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘রাজধানীতে শতাধিকসহ সারাদেশে কয়েকশ’ শিবির চালিত মেস রয়েছে। প্রতিটি মেসই ভয়ঙ্কর। এসব মেসে গোপন বৈঠকের মাধ্যমে নিজ স্বার্থ বা কোন উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য ককটেল, হাতবোমা ও পেট্রোল বোমা তৈরি ও ব্যবহার করে নৈরাজ্য ও নাশকতা সৃষ্টি করে দেশের জনগণের জানমালের ক্ষতি সাধন করে চলেছে শিবির। এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে র‌্যাব।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, রাজধানীতে এই মুহূর্তে কতগুলো শিবিরের মেস রয়েছে তার সঠিক তথ্য নেই তাদের কাছে। তবে বিভিন্ন সূত্র মারফত যতটুক তথ্য পাওয়া গেছে তার সংখাও অনেক। শিবিরের বেশিরভাগ মেসই বোমা তৈরির কারখানা। এখান থেকেই চোরাগুপ্তা বোমা হামলার পরিকল্পনা করা হয়। এসব মেসে তৈরি বোমাই ছাত্রদলের ক্যাডারা ব্যবহার করছে। বোমা হামলার ঘটনায় ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। যখন-তখন যার-তার ওপর দানবের মতো আছরে পড়ছে চোরাগুপ্তা বোমা।

র‌্যাবের গোয়েন্দা তথ্যমতে, শিবিরে জঙ্গিদের মত বোমা বিশেষজ্ঞ আছে। এর আগে শিবিরের ঘাঁটি রাজশাহী থেকে গ্রেপ্তারৃকত শাহাদত র‌্যাবকে জানিয়েছিল, তিনি নিজেসহ কয়েকশ সদস্য বোমা তৈরিতে এক্সপার্ট। শিবির কারো সহযোগিতা নেয় না। দলের প্রয়োজনে তারা অস্ত্র ও বোমা তৈরি এবং হামলা চালানোর জন্য আলাদা ইউনিট গঠন করে রেখেছে। তাদের সঙ্গে উগ্রবাদীদেরও যোগাযোগ রয়েছে।

বনানী থানার ওসি ভুঁইয়া মাহবুব হাসান জানান, গত বুধবার ভোরের দিকে মহাখালীর টিবি গেইটের চ-ব্লকের ১৩৩/১ নম্বর আমিনুল ইসলাম ভিলা নামে একটি বাসার শিবিরের মেস থেকে গান পাউডারসহ বিপুল বিস্ফোরক ও বোমার উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে শিবিরের বনানী থানার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ছাড়াও গ্রেপ্তার করা হয় জয়নাল আবেদিন, আরিফুজ্জামান আরিফ, আতিয়ার রহমান ও খালিদ সাইফুল্লাহ নামে আরো চার শিবির সদস্যকে। গ্রেপ্তারকৃতদের ৫ দিনের রিমাণ্ডে এমন তথ্যসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে।

তাদের তথ্যমতে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিবির চালিত শত শত মেস রয়েছে। কোথাও হামলা চালানোর প্রস্তুতি নেয়ার আগে ওইসব মেসে মজুদ রাখা বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, অস্ত্র, বোমা কাজে লাগানো হয়। চলমান হরতাল, অবরোধের মধ্যে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সহযোগিতার পাশাপাশি নিজেরাও বোমা হামলা চালিয়ে অস্থিরতা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা করেছে তারা।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে দাবি করে ওসি মাহ্বুব হাসান জানান, সারাদেশে শিবিরের মেস বোমা তৈরির কারখানা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলে গ্রেপ্তারকৃতরা স্বীকারোক্তি দিয়েছে। ইতোমধ্যে সেখান থেকে প্রায় ২ হাজার হাত বোমা তৈরি করে চলমান হরতাল অবরোধে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। বোমা তৈরি করার পাশাপাশি এরা বোমা নিক্ষেপেও পারদর্শী। এরা মেসে বোমা তৈরি করে ঢাকাসহ ঢাকার আশপাশের অন্য এলাকার শিবির কর্মীদের সরবরাহ করতো। বিভিন্ন কৌশলে এরা নাশকতা চালায়।

গাড়ি পোড়ানোর কৌশল হিসেবে ওসি বলেন, ‘তারা প্রথমে রাস্তায় পেরেক ছেড়ে দিয়ে চাকা পাংচার করে। পরে গাড়ি থেমে গেলে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পেট্রোল বোমা মারার আগে ওই এলাকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি আগে থেকে দেখে ( রেকি) নেয়।’

সূত্র জানায়, মহাখালী শিবিরের মেস থেকে ১৩০টি অবিস্ফোরিত ককটেল, দুই লিটার পেট্রোল, বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহৃত ১০ কেজি পাথরের গুড়া, ১ কেজি গান পাউডার, ১২টি স্কসটেপ, তিন কেজি ধারালো চার কোন বিশিষ্ট প্যারেক, তিন কেজি তুলা, একটি কাচি, ১৫টি জর্দার কালি কৌটাসহ সংগঠনের বইপত্র উদ্ধার করা হয়। ওই বাসার দ্বিতীয় তলায় গ্রেপ্তারকৃতরা বোমা তৈরির কারখানা গড়ে তোলে। গত এক মাসে এতো বিস্ফোরক দ্রব্য শিবিরের কোনো মেস থেকে উদ্ধার হয়নি। এভাবে পুরান ঢাকার কোতোয়ালি, লালবাগসহ মগবাজার, যাত্রাবাড়ি, খিলগাঁও, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, উত্তর-দক্ষিণখান, উত্তরা, কেরানীগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়াম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের মেসগুলো বোমা তৈরির কারাখানা হিসেবে ব্যবহার করে। এ ছাড়া রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকাগুলো শিবিরের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেখানেও বোমা তৈরি করা হচ্ছে।

গ্রেপ্তারকৃতরা স্বীরোক্তি দিয়েছে, তারা লেখাপড়ার পাশপাশি দলীয় মিছিল, মিটিংয়ে অংশ নেন। তাদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান বনানী থানা ছাত্র শিবিরের সভাপতি হিসেবে এলাকার বোমাবাজদের নিয়ন্ত্রণ করত। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। জবিতেও বোমা হামলার ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালিগঞ্জ থানার চরচৈলাদি এলাকায়। বেসরকারি প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি (অনার্স) ৩য় বর্ষের ছাত্র জয়নাল আবেদীন গুলশান এলাকার অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের কর্মকাণ্ড দেখাশোনা করত। তার গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী থানার কলোনীপাড়ার বাঁশবাড়িয়ায়। ঢাকা পলিটেকনিকের আর্কিটেক্ট বিভাগের ২য় সেমিস্টারের ছাত্র আরিফুজ্জামান আরিফ মুলত বোমা তৈরির প্রধান কারিগর। বনানীর মেসে যত বোমা তৈরি করা হতো তার ফর্মূলামতে। তার গ্রামের বাড়ি মেহেরপুর জেলার হঠাৎপাড়া এলাকায়।

সরকারি তিতুমীর কলেজে (অনার্স) ভর্তির অপেক্ষায় থাকা খালিদ সাইফুল্লাহকে ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিবিরকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বোমা সরবরাহ করত। তার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের ছোট কামারকু এলাকায়। তিতুমীর কলেজে ইংরেজি (অনার্স) শেষ বর্ষের ছাত্র আতিয়ার রহমানও বোমা তৈরির পাশাপাশি হামলায় অংশ নিতো। তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা থানার দক্ষিণ উল্লাহ এলাকায়।



মন্তব্য চালু নেই