শিশু রাজন হত্যা : পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে হয়েছিল আপসের চেষ্টা

সিলেটে শিশু শেখ মো. সামিউল আলমকে (রাজন) হত্যার ঘটনা পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে আপসের প্রস্তাব দিয়ে দেশ ছাড়ে অন্যতম অভিযুক্ত কামরুল ইসলাম (২৮)। সৌদি আরবের জেদ্দায় আটক ওই কামরুলকে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক।

এদিকে প্রধান আসামি মুহিত আলমের শ্যালক সন্দেহভাজন ইসমাইল হোসেন আবলুচকে (৩২) মঙ্গলবার পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। আর প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়া আজমত উল্লা ও ফিরোজ আলী আদালতে জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে সামিউলের বাবা শেখ আজিজুর রহমানের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সামিউলের বাবা আজিজুর রহমান ও তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে বাদেয়ালি গ্রামে গিয়ে কামরুলের আত্মীয় পরিচয় দেওয়া তিনজন লোক পাঁচ লাখ টাকা আজিজুরকে দেওয়ার প্রস্তাব করে। এতে আজিজুর সম্মত না হওয়ায় ওই তিনজন ফিরে যায়। পরে সামিউলের পরিবারের পক্ষ থেকে কামরুলের প্রস্তাবের বিষয়টি পুলিশকেও জানানো হয়।

বিভিন্ন সূত্র জানায়, ঘটনার পরপরই গা-ঢাকা দিলেও কামরুল পুলিশের হাতে আটক বড় ভাইকে ছাড়ানোর চেষ্টা শুরু করে। এ চেষ্টার শুরুতে প্রথম দফা পরিচিত আওয়ামী লীগের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে লোক মাধ্যমে যোগাযোগ করে। এতে ব্যর্থ হয়ে শেষে সামিউলের পরিবারের সঙ্গে আপসের প্রস্তাব পাঠায়। পরে সৌদি আরব পালিয়ে যায়।

হত্যার কারণ সম্পর্কে সামিউলের বাবা আজিজুর যৌন নির্যাতনকে একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। গতকাল তিনি বলেন, সামিউলকে যৌন নির্যাতন করতে চেয়েছিল চৌকিদার ময়না ওরফে বড় ময়না। রাজি না হওয়ায় চৌকিদার চুরির অভিযোগ তুলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। এ ঘটনায় স্থানীয় ইউপি সদস্য গিয়াসউদ্দিনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কামরুল পালানোর ক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে ইউপি সদস্য মধ্যস্থতার অভিযোগও করেন তিনি।

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্র জানায়, কামরুল গত শুক্রবার বেলা আড়াইটায় বাংলাদেশ বিমানের বিজি ৪০৪ ফ্লাইটে দেশ ছাড়ে। ইমিগ্রেশনের একজন কর্মকর্তা জানান, কামরুলের সৌদি আরবের রি-এন্ট্রি ভিসা থাকায় শুধু টিকিট করে সহজে চলে যেতে সক্ষম হয়।

সামিউলকে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে দেখে সৌদি আরবের জেদ্দায় গত সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত আটটায় কামরুলকে আটক করেন স্থানীয় বাংলাদেশিরা।

আইজিপি শহীদুল হক গতকাল গাজীপুরে কালিয়াকৈরের চন্দ্রা মোড় এলাকায় মহাসড়ক পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, শিশু সামিউল হত্যায় অভিযুক্ত কামরুলকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। সামিউলের বাবা আজিজুর শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছিলেন, তিনি ঘটনার দিন বুধবার রাতে থানায় মামলা করতে গেলে সিলেট মহানগরের জালালাবাদ থানার পুলিশ তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। মামলা নিতেও অপারগতা প্রকাশের পাশাপাশি প্রকৃত খুনিদের আড়ালের চেষ্টা চালিয়েছেন। এ ছাড়া মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মামলার অন্যতম আসামি কামরুলকে সৌদি আরবে পালিয়ে যেতেও পুলিশ সাহায্য করেছে।

তদন্ত কমিটি গঠন: সামিউলের বাবার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল পুলিশের তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এস এম রুকন উদ্দিনকে তদন্ত কমিটির প্রধান করে এ কমিটি গতকাল থেকে কাজ শুরু করেছে।

এ ব্যাপারে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মো. রহমত উল্লাহ বলেন, ‘শিশু সামিউলের বাবার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের গাফিলতি এবং ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখার জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’

মুহিতের শ্যালকও রিমান্ডে: মুহিত আলমের শ্যালক সন্দেহভাজন ইসমাইল হোসেন আবলুচকেও (৩২) রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গতকাল সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ইসমাইলকে হাজির করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিলেটের জালালাবাদ থানার পরিদর্শক মো. আলমগীর হোসেন সাত দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করলে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আদালতে জবানবন্দি : ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়া আজমত উল্লা ও ফিরোজ আলী আদালতে জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক মো. সাহেদুল করিম তাঁদের জবানবন্দি ১৬১ ধারায় রেকর্ড করেন। পরে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। গত সোমবার গ্রেপ্তার হওয়া মুহিতের স্ত্রী লিপি বেগমকেও গতকাল কারাগারে পাঠানো হয়।

সামিউলের বাড়িতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনার: শিশু সামিউলের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. জয়নাল আবেদীন ও সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার মো. কামরুল আহসান। গতকাল বেলা ১১টায় তাঁরা সামিউলের বাড়িতে গিয়ে খুনিদের যথাযথ বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে আশ্বাস দেন।

এ সময় জেলা প্রশাসক সামিউলের পরিবারকে নগদ ২০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করেন। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সোলাইমান রুবেল এবং ব্রিটিশ বাংলা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পক্ষ থেকেও সামিউলের পরিবারকে অর্থসহায়তা দেওয়া হয়।

জেলা প্রশাসক বলেন, সামিউল হত্যার বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে করার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলা হবে।

প্রতিবাদ অব্যাহত: শিশু সামিউল হত্যার প্রতিবাদে গতকাল দিনভর সিলেটে নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টায় নগরের চৌহাট্টা এলাকার সিলেটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে সিলেটের বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। মানববন্ধন কর্মসূচিতে সামিউল হত্যায় জড়িতদের বিচার ও চিহ্নিতদের ফাঁসির দাবি জানানো হয়। কর্মসূচিতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্লাস্ট, এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো), সিএসআইডি, সচেতন নাগরিক কমিটি, ইয়েস, টিআইবি, সিলেট যুব একাডেমি, মহিলা পরিষদ, দুর্বার নেটওয়ার্ক, মেলা সমাজকল্যাণ সংস্থাসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন অংশ নেয়। বেলা দুইটার দিকে নগরের সুবিদবাজার এলাকায় সিলেট প্রেসক্লাবের সামনে সিলেট ব্লগারস অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্টের উদ্যোগে সামিউল হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

বেলা আড়াইটায় ঘটনাস্থল কুমারগাঁও-সংলগ্ন তেমুখী পয়েন্টে সামিউল হত্যার প্রতিবাদে সিলেট সদর উপজেলাবাসীর ব্যানারে একটি প্রতিবাদী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গত বুধবার খুঁটির সঙ্গে সামিউলকে (১৪) বেঁধে রোলার দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নির্যাতনকারীরাই সামিউলকে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ধারণ করে। সামিউলের লাশ ফেলতে গিয়ে ধরা পড়ে কামরুলের বড় ভাই মুহিত আলম (৩৫)। এ ঘটনায় সিলেট মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। মামলায় মুহিত ও কামরুল ছাড়াও হায়দার আলী ওরফে আলী নামে তাদের আরও এক ভাই ও কুমারগাঁওয়ের চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়নাকে আসামি করা হয়।



মন্তব্য চালু নেই