শিশু হত্যার কারণ সিনেমা-সিরিয়াল ?

শিশুর জন্য ভালোবাসা করো তোমরা অনুভব। চাই বাধা বন্ধন মুক্ত আনন্দময় শৈশব।…আমি বাবা ও মায়ের আদরের সন্তান, আমার তো মন আছে …। শিশুর প্রতি ভালোবাসায় এসব গান রচিত হয়েছে। আগে টিভিতে এসব গান শোনা যেত, শিশুদের প্রতি একটা আলাদা টান তৈরির উপাদান পাওয়া যেতো। এখন টিভি খুললে এসব গান আর শোনা যায় না।

সম্প্রতি দেশে শিশু হত্যা বেড়ে চলেছে। শিশুরা বিপদে পড়ছে অপরাধীদের নিত্য নতুন কৌশলে। দিন দিন কৌশল পাল্টাচ্ছে অপরাধীরা। এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিটিও এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরও থামছে না শিশু হত্যা। সন্ত্রাসী ছাড়াও আত্মীয় স্বজন এমনকি মা নিজেও শিশু হত্যা করছেন- এমন ঘটনাও ঘটছে।

সবশেষ গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রামপুরার বনশ্রীতে একটি বাসায় দুই ভাইবোনের মৃত্যু হয়। পরিবারের সদস্যরা দাবি করে, চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে আনা খাবার খেয়ে এমন হয়েছে। কিন্তু পরদিন ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে দেখা যায়, তাদেরকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।

ঘটনা অনুসন্ধানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তৎপরতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠে নামে। গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি র্যা ব সদস্যরাও অনুসন্ধান করতে নামেন।

জামালপুর থেকে বাবা, মা ও খালাকে আটক করে ঢাকায় নিয়ে আসে র‌্যাব। শিশু দুটির মা মাহফুজা মালেক স্বীকার করেন দুই সন্তানকে হত্যার কথা। এ ঘটনায় শিশুদের বাবা বাদী হয়ে মাহফুজার বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলায় মাহফুজা ৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।

গত ১ মার্চ সকালে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলায় পুরাতন হাসপাতালের সামনের নালা থেকে পুলিশ উদ্ধার করে নিখোঁজ রিয়াদের (১০) লাশ । পুলিশ জানায়, ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শিশুটি নিখোঁজ ছিল।

২৭ ফেব্রুয়ারি একই জেলার দক্ষিণ রসুলপুর এলাকায় দুই সহোদর ভাইকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এ হত্যার প্রধান আসামি ছোটনকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

অন্যতম আলোচিত ঘটনা হচ্ছে, হবিগঞ্জে একই পরিবারের চার শিশুকে হত্যা। ওই চার শিশুকে হত্যা করে বালু চাপা দেওয়া হয়। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডে ৬ জনকে আটক করে পুলিশ পারে, শিশুদের বাবাদের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে প্রতিশোধ নিতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।

গত ২৯ জানুয়ারি খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার মুগারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহ। টেলিফোন করে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হলে দুই দফায় মোট দুই লাখ টাকা দেয় তার পরিবার। এরপর ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে শিশুটির গলিত লাশ পাওয়া যায় তার মায়ের দিকের আত্মীয় মোতাহার আব্দুল্লাহর বাড়িতে একটি ড্রামের ভেতর। এ ঘটনায় মোতাহার আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি র্যা বের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন।

এর আগে খুলনায় রাকিব এবং সিলেটে রাজন হত্যার ঘটনা দেশে ব্যপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

শিশু হত্যা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও অপরাধ বিজ্ঞানী ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘শিশুকে বেছে নেয়াটা সহজতর উপায়। তাই প্রতিশোধ বলেন আর মুক্তিপণ বলেন, উভয় দিক থেকেই শিশুকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা শিশুদের প্রতি ঠিকমতো খেয়াল রাখেন না- এটাও একটা কারণ। তারা শিশুদের অবাধে যার তার সঙ্গে মিশতে দেন। এই মুহূর্তে শিশুকে নিজের কোলে রেখে বড় করতে হবে। কারও প্রতি আর বিশ্বাস নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে মানুষের দুরত্ব কমাতে হবে। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। প্রয়োজনে শিশুকে বেশি করে সময় দিতে হবে। পাশাপাশি কাছের লোকদের গতিবিধি লক্ষ রাখতে হবে। আর শিশুদেরও এদের থেকে দূরে থাকার কথা বলতে হবে। মিশবে, কিন্তু যখন তখন যে কোনো কথা যেন তারা না শোনে।’

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল বলেন, ‘বেশ কিছু দিন থেকে পারিবারিকভাবে সম্পর্কে ফাটল দেখা যাচ্ছে। কেউ কারো বাসায় যাতায়াত করছে না। একক পরিবার ভেঙে বহু পরিবারে রূপান্তর হচ্ছে। সমাজে কৃষ্টিকালচার অনেকটা কমে গেছে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাত্রা তো একেবারেই শুন্যের কোঠায় এসেছে। এসব নানা কারণে মানুষ একজন আরেকজনের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠছে। শিশু হত্যার পেছনে এসব ভূমিকা পালন করছে।’
এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ বলেন, ‘ভারতীয় কিছু সিরিয়াল অপরাধীদের হত্যার কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করা হয়। কারণ, অনেককে গ্রেফতারের পর কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেছেন, বিভিন্ন সিনেমা ও সিরিয়াল দেখে এসব কৌশল শিখেছেন।’রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই