নির্বাচন ইস্যু : সংবিধান থেকে একচুলও নড়বে না আ.লীগ

এবার নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ইস্যু সামনে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি। তবে এতে কোনো সায় নেই ক্ষমতাসীনদের। তাদের এককথা, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেই। বিএনপি এখনো এটা মানতে না পারলে তাদের কিছুই করার নেই। কারণ বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে মীমাংসিত। এই প্রশ্নে সংবিধানের দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন পরিবর্তন হবে না।

আওয়ামী লীগের এমন কঠোর অবস্থানে কোনো আপত্তি নেই সরকারের মিত্রস্থানীয় বিরোধী দল জাতীয় পার্টির। উপরন্তু দলের চেয়ারম্যান অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছেন যে, দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে জাতীয় পার্টি, এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ৩০০ আসনে। তবে কী ধরনের সরকার হলে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরা নির্বাচনে অংশ নেবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ বিএনপির পক্ষ থেকে সম্প্রতি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি সামনে আনা হলেও এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়নি।

বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গীরা ছাড়াও লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক প্রশাসনিক ও আনুষঙ্গিক সহযোগিতা দেয়ার জন্য একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার গঠনের পক্ষে। বিএনপির আরেক মিত্র বিকল্পধারা চায় নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি করছে খেলাফত আন্দোলন। তবে সাংবিধানিকভাবেই বর্তমান সরকারের কর্তৃত্ব সংকুচিত করে নির্বাচনকালীন সরকারের কাজ তত্ত্বাবধানমূলক ও অত্যাবশ্যক রুটিন কিছু কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষে সিপিবি।

বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই প্রস্তাব বিএনপি প্রত্যাখ্যান করে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একদফা এক দাবিতে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। একই সঙ্গে তারা নির্বাচন প্রতিহত করারও ঘোষণা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এরশাদের জাতীয় পার্টি, ১৪ দলীয় জোটভুক্ত জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও সাম্যবাদী দলের প্রতিনিধিত্বে ২৯ মন্ত্রী এবং ১০ উপদেষ্টা নিয়ে গড়ে ওঠে নির্বাচনকালীন সরকার।

বিএনপি-জামায়াত ও তাদের জোটভুক্ত দলগুলো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের ঘোষণা দিলে অর্ধেকেরও বেশি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। বিএনপিকে নিয়ে আবার নির্বাচন হবে- এমন আশা এক বছরেও পূর্ণ না হলে ওই নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপির তিন মাসের লাগাতার অবরোধে যানবাহনে আগুন ও পেট্রলবোমার আঘাতে শতাধিক সাধারণ নারী, পুরুষ ও শিশু মারা যায়।

ওই আন্দোলনের জেরে বিএনপির শীর্ষনেতাদের হুকুমের আসামি হয়ে দাঁড়াতে হয় কাঠগড়ায়। হামলা, মামলায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জর্জরিত বিএনপি এর পর থেকে বিভিন্ন সময় আন্দোলনের কথা বললেও ঘর গুছিয়ে আর মাঠে নামতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক দফা এক দাবি থেকে সরে এসেছে বিএনপি। ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই থেকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার এবং গত ১৮ নভেম্বর থেকে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বলছেন দলটির নেতারা। যথসময়ে ওই সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। বিএনপির ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, সংবিধানের মধ্য থেকেই একটা ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা করছেন তারা। সংসদের বাইরে থাকা সত্ত্বেও এ দফায় তাদের সরকারে ডাকা হলে তারা সাড়া দিতে পারেন। তবে দলটি নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করতে চায়।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই সরকারই সহায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করবে। এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না।

একই রকম মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারই নির্বাচনের সময় সহায়ক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বিষয়টি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেই ফয়সালা হয়ে গেছে। বিএনপি যদি এখনো এটা মানতে না পারে, তবে আমাদের কিছুই করার নেই। তিনি আরো বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে মীমাংসিত। এই প্রশ্নে সংবিধানের দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন পরিবর্তন হবে না।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা সংবিধানে নেই। এই সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- এ বিষয়টিই সংবিধানে উল্লেখ আছে। এটা খুব স্পষ্ট। সংবিধান মেনে নির্বাচন হলে এটাই হবে। গতবার প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিজ উদ্যোগে সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করেছিলেন। বিরোধীদলীয় নেত্রীকেও জ্বালাও-পোড়াও বাদ দিয়ে সরকারে অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেবার বিএনপি তা মানেনি। গতবার প্রধানমন্ত্রী বদান্যতা দেখিয়েছিলেন। এবার এমনটি হবে বলে মনে হয় না। এবার তিনি সংবিধানের বাইরে একচুলও নড়বেন না।

তবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনকালীন একটি সহায়ক সরকার প্রয়োজন। তবে এর কাঠামো কেমন হবে তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা উচিত।

অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সাবেক চিফ হুইপ জয়নাল আবেদিন ফারুক বলেন, এখন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে আমরা নির্বাচনকালীন সকারের প্রস্তাব উত্থাপন করব।

নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার বলতে বিএনপি কী বোঝাতে চাচ্ছে, এটা কেন উত্থাপন করা হচ্ছে না, কেন দেরি হচ্ছে, জানতে চাইলে জয়নাল আবদিন ফারুক বলেন, যারা ধীরে চলে তারাই জয়লাভ করে। সব দলেরই একটা রাজনৈতিক কৌশল থাকে। আমরা এখনই সব কথা বলতে চাই না।

তবে নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, বর্তমান সংবিধানে কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধায়ক) সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত। বিএনপিও বিলুপ্ত বিষয়টিকে সামনে আনার দাবি করছে না। আমাদের দাবি, বর্তমান সরকার তাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করুক। তাহলেই নিরপেক্ষ কমিশন, নিরপেক্ষ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারবে। তবে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতা খর্বের বিষয়টি সামনে আসতে হবে।



মন্তব্য চালু নেই