অতিষ্ট নগরবাসী, নেই কার্যকর উদ্যোগ

সনাতন পদ্ধতিতেই মশা নিধন, নেই সাফল্য

রাজধানীর কাঁঠালবাগানের বক্স কালভার্ট এলাকার বাসিন্দা আবু তালেব। ঘরে মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। ছোট্ট এই প্রাণীটি তার জীবনকে বিষিয়ে দিয়েছে। শীতে তাও প্রকোপ খানিকটা কম ছিল। বসন্ত আসার পর উপদ্রব আরও বেড়েছে। কয়েল, অ্যারোসেল কিছুই কাজ করে না। আর ঘরের মশা কোনোভাবে মারলেও লাভ নেই। কারণ দরজা-জানালা খুললেই ঝাঁকে ঝাঁকে ঘরে ঢুকে পড়ে মশা। ভন ভন শব্দে কানের পাশ দিয়ে উড়ে বেড়ানো এই প্রাণীটি যখন হুল ফুটিয়ে রক্ত পান শুরু করে, তখন বিরক্তি চরমে উঠে আবু তালেবের। এই বিরক্তি প্রাণীটির প্রতি যতটা না তার চেয়ে বেশি নগর কর্তৃপক্ষের প্রতি।কারণ শেষ কবে ওই এলাকায় মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা ছিল তা মনেই করতে পারছেন না তিনি।

এই বসন্তের দখিনা হাওয়ার আনন্দ কি আবু তালেব উপভোগ করবেন না? দিন-রাত সব সময়ই দরজা-জানালা বন্ধ রাখা সম্ভব? তিনি বলেন, ‘মশা মারিয়া শেষ করি বাহে (মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি)। রাতে ঘুমাবার পারি না বাহে। মশারিতেও কাজ হয় না।’ একই অভিযোগ শাহবাগের বাসিন্দা শওকতের। তিনি বলেন, ‘কবে মশার ওষুধ দেওয়া হয়েছে তা জানি না।’ মশার কামড়ে তার এলাকায়ও বাসায় থাকা দায় বলে জানান তিনি। ভিআইপি এলাকা মিন্টো রোড, বেইলী রোড ও ইস্কাটন গার্ডেনের বাসিন্দারাও মশার যন্ত্রণার কথা জানিয়েছেন। তবে সচিব, মন্ত্রীদের আবাস এই এলাকায় মাঝেমধ্যে ওষুধ ছিটানো হয় বলে জানিয়েছেন তারা। তবে তাতে কাজ হয় না অতটা। এর কারণ ওষুধে ভেজাল নাকি যে ওষুধ ছিটানো হয় তা মশা মারতে আর কার্যকর নয়, তা বুঝতে পারছেন না তারা।

নগরবাসীর অভিযোগ, মশা নিধনে সমন্বিত উদ্যোগ নেই। নালাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না, নগরের লেক ও ডোবাগুলোও ময়লা আবর্জনায় ভর্তি। আর এগুলোতে বাসা বেঁধেছে মশা। নগরবাসীর নিজের অসচেতনতাও এর জন্য কম দায়ী নয়। নিজ ঘর নিয়মিত পরিচ্ছন্ন না রাখা, বিশেষ করে স্টোররুমে এলোমেলো করে জিনিসপত্র ফেলে রাখা, এখানে-সেখানে আবর্জনা ফেলা এ সব বদ-অভ্যাস পাল্টাচ্ছে না সেভাবে। ফলে মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজধানীর সব এলাকার মানুষ। নগরীর উপকণ্ঠের পরিস্থিতি আরও খারাপ। অথচ মশা নিধন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্যতম একটি কাজ। দুই করপোরেশন ছাড়াও আরও একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব প্রাণীটির বংশ বিস্তার রোধ করা। এ খাতে সরকারের বরাদ্দও কম নয়। কিন্তু কোনোভাবেই রাজধানীর মশার উপদ্রব কমছে না।

মশা নিয়ে বছরজুড়ে বিরক্তি থাকে নগরবাসীর। তবে দক্ষিণ আমেরিকায় মশাবাহিত ভাইরাস জিকা ছড়িয়ে পড়ার পর রীতিমতো বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এরই মধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করেছে। দক্ষিণ আমেরিকা সফরে যাওয়া ইউরোপ-আমেরিকার বহু বাসিন্দা আর বাংলাদেশের কাছাকাছি এলাকা চীনেও পাওয়া গেছে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী। এই রোগ নিয়ে সবচেয়ে বড় উৎকণ্ঠার কারণ আক্রান্তদের সন্তানও এতে আক্রান্ত হয়। আর গর্ভে থাকা অবস্থায় মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত হলে শিশুর মস্তিষ্ক স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হয়। ফলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। এই অবস্থায় ব্রাজিলে আগামী দুই বছর সন্তান না নিতে দেশবাসীকে অনুরোধ করেছে সরকার। পাশাপাশি মশা নিধনে দুই লাখ সেনা নামিয়েছে দেশটি।

ডেঙ্গুর মতোই জিকার বিস্তার ঘটায় এডিস মশা। বছর দশেক ধরে বাংলাদেশেও এডিস মশা এই ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটিয়েছে। কিন্তু এই মশা প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে সরকার। ফলে এখন পর্যন্ত জিকার ভাইরাস না ছড়ালেও এডিস মশার আধিক্যের কারণে ভাইরাসটি একবার ছড়ালে তা রোধ করা কঠিন হয়ে যাবে বলেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরকার অবশ্য দেশবাসীকে আশ্বাস দিয়ে বলেছে, জিকা প্রতিরোধে যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে সরকারের। আর কেউ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার দায়িত্বও নেবে সরকার। কিন্তু এই প্রস্তুতি আদৌ কতটা আছে সে প্রশ্ন উঠছে নগরবাসীর মধ্যে। কারণ ভাইরাসের বাহক মশা নিধনেই চোখে পড়ার মতো কোনো উদ্যোগ নেই।

সনাতন পদ্ধতিতেই মশা নিধন, নেই সাফল্য

গত বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় মশা নিধন কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। এর আগেও এই প্রক্রিয়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিযান চালানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কতটা কাজ হয় সে প্রশ্ন আছে। নগরীতে মশা নিধনের দায়িত্বে দুই সিটি করপোরেশন ছাড়াও আছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মশক নিবারণী দপ্তর। দুই করপোরেশনের জন্য প্রতিষ্ঠানের জন্য চলতি অর্থবছরেও বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মশক নিবারণী দপ্তরের বরাদ্দ না রাখলেও লোকবল দেওয়াসহ এ বিষয়ে দুই ডিসিসিকে সহায়তা করে আসছে। গত অর্থবছরেও দুই সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ছিল ১৯ কোটি টাকার বেশি। আগের বছর যা ছিল ১৭ কোটি টাকা। তারও আগের বছর ১৪ কোটি টাকা। এভাবে প্রতি বছর বরাদ্দ বাড়লেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মশার উপদ্রব।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই সিটি করপোরেশনেরই একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, মশা নিয়ন্ত্রণের এই বরাদ্দ সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কি না তা তদারকি করা কঠিন। এই সুযোগে বরাদ্দের বড় অংশই লোপাট হয়। আর মশক নিধন বিভাগ মাঝেমধ্যে লোক দেখানো কার্যক্রম চালায়। সরকারি হিসাবে দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের সাত শরও বেশি শ্রমিকের মশা নিধনে কাজ করার কথা। প্রতি ওয়ার্ডে আছে অন্তত সাতজন করে শ্রমিক। তাদের সকালে নালা-নর্দমায় ওষুধ ছিটানো এবং বিকালে স্প্রের মাধ্যমে মশাপ্রবণ এলাকায় উড়ন্ত মশা মারার কথা। কিন্তু মাঝেমধ্যে বিকালে কোথাও কোথাও উড়ন্ত মশা মারতে স্প্রে করতে দেখা গেলেও সকালে ওষুধ ছিটানো একেবারেই বিরল। আবার মশার ওষুধ ছিটানোর ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ আছে। পানি বা অন্য কোনো তরলে যে পরিমাণ ওষুধ দিয়ে স্প্রে করার কথা, তা না করে কম ওষুধ মেশানোয় এই কার্যক্রমের সুফল মেলে না বলে অভিযোগ আছে। আবার যে ওষুধ ছিটানো হয় তা আর এখন কার্যকর কি না সে গবেষণাও নেই সিটি করপোরেশনের।

তবে এবার ঢাকার নতুন দুই মেয়র মশা নিধন কার্যক্রম জোরালো করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এর সুফল অচিরেই পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এম এ হামিদ খান বলেন, ‘আমাদের মশা নিধন কার্যক্রম থেমে নেই। তবে ওষুধের সরবরাহ কম, তাই কাজে সেভাবে গতি নেই। সরবরাহ বাড়লেই পুরোদমে কাজ শুরু হবে।’ তিনি বলেন, ‘আগে ওষুধ ছিটানোই হতো না। তবে নির্বাচিত মেয়র এবং কাউন্সিলর আসার পর কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় ওষুধ ছিটানো হয়।’ কবে নাগাদ ওষুধের সরবরাহ বাড়বে জানতে চাইলে এই ওয়ার্ড কাউন্সিলর বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনকে চাহিদার কথা জানিয়েছি। আশা করছি খুব শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে।’

যেসব এলাকায় ওষুধ ছিটানো হয়েছে বলে কাগজে-কলমে বলা হয়, সেগুলোতে আদৌ কর্মীরা ঠিকভাবে কাজ করছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এই জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘ওষুধ ছিটানোর পর ওই এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। মাস শেষে ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই সংশ্লিষ্ট কর্মীর বেতন দেওয়া হয়।’ তবে ওয়ার্ড কাউন্সিলর এম এ হামিদ খানের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল পাওয়া গেছে কম। নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি থেকে মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। বাসাবাড়ি, কর্মস্থল, চলতি পথেও মশা থেকে নিস্তার মিলছে না। রাজধানীর মগবাজার, রামপুরা, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, নিউমার্কেট, মিরপুর, জুরাইন, বাড্ডা, মহাখালী, কড়াইল, নিকুঞ্জ এবং মোহাম্মদপুর এলাকায় এই অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রম চালু আছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই বাড়তি কর্মসূচি নেওয়া হবে।’ এটা শেষ হলে মশার উপদ্রব কমবে বলে আশাবাদী তিনি। নগরবাসীকেও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘জলাশয় আর নালা-নর্দমায় এটা ওটা ফেলে দেওয়ার অভ্যাস পাল্টাতে হবে নগরবাসীকে। সবাই মিলে সহযোগিতা না করলে আমরা যতই চেষ্টা করি, নাগরিক দুর্ভোগ লাঘব করাতে পারব না।’ জিকা ভাইরাসের বিষয়টি সিটি করপোরেশনের মাথায় আছে কি না জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘জিকা ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। এখন এডিস মশা নেই। এটি বর্ষা মৌসুমে জন্ম নেয়। তাই আমরা জুন-জুলাইয়ের দিকে এডিস মশা নিধনে মাঠে নামব। এখন যে মশা দেখা যায় সেগুলো কিউলেক্স মশা।’-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।



মন্তব্য চালু নেই