সাঁওতাল পল্লীতে আগুন দিয়েছে পুলিশ, প্রতিবেদন দাখিল

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর সুগার মিল এলাকায় সাঁওতাল পল্লীতে আগুন দেয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য সরাসরি জড়িত মর্মে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।

সোমবার এফিডেভিট আকারে হাইকোর্টে ৬৫ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন দাখিল করেন গাইবান্ধার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহিদুল্লাহ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন লাগানোর ঘটনার জন্য স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তি এবং এই ঘটনার সময় দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য দায়ী। এই আগুন লাগানোর ঘটনার সাথে দুজন পুলিশ সদস্য ও গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) একজন সদস্য সক্রিয়ভাবে জড়িত।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘আল জাজিরা টেলিভিশনে প্রদর্শিত ভিডিও ক্লিপ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, কিছু পুলিশ সদস্য এবং দুজন সিভিল পোশাকধারী ব্যক্তি সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন লাগানোয় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। আরও কিছু পুলিশ সদস্য কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন যারা আগুন লাগানোয় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি। তবে তারা আগুন নেভানোর চেষ্টাও করেননি।’

ঘটনার বিবরণ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, চামগাড়ী বিল ও কুয়ারমারা নামক স্থানে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে। সাহেবগঞ্জ ও হরিণমারী এলাকায় আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার পরে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে এবং হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি দেখে বসতি স্থাপনকারীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আগুন লাগানোর আগেই নির্মিত স্থাপনা থেকে আনুমানিক ৫০০/৬০০ গজ দূরে মাদরপুর ও জয়পুর গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিলো মর্মে সাক্ষীদের বক্তব্যে সুস্পষ্ট হয়েছে। ফলে এরূপ প্রেক্ষাপটে সাক্ষীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ আগুন লাগানোর ঘটনায় জড়িত স্থানীয় অপরাধীদের সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারেননি। তাছাড়া কোনো কোনো সাক্ষী তাদের জবানবন্দিতে আগুন লাগানোর ঘটনায় বিভিন্ন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করলেও তাদের উপস্থিতির বিষয়টি বর্ণিত প্রেক্ষাপটে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পোশাক পরিহিত থাকায় সাঁওতালদের স্থাপনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশের গুলির আওয়াজে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে সাঁওতালরা তাদের স্থাপনা ছেড়ে চলে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে গ্রুপটি খামারের ভেতরে প্রবেশ করেছিল তারাই চামগাড়ী বিল নামক স্থানে সাঁওতালদের নির্মিত স্থাপনার কাছে গেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘পেনড্রাইভে প্রদত্ত ভিডিও ক্লিপসূমহ পর্যবেক্ষণে এবং ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল ও অন্য সাক্ষীদের পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, চামগাড়ী বিল নামক স্থানে নির্মিত স্থাপনা থেকে সাঁওতালরা চলে যাওয়ার পর আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশ, র‌্যাব ও ডিবির পোশাক পরিহিত সদস্য এবং সাধারণ পোশাকধারী দুইজন ব্যক্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ওই গ্রুপটির মধ্য হতে পুলিশ লেখা পোশাকধারী দুজন, ডিবি লেখা পোশাকধারী একজন ও সাধারণ পোশাকধারী দুজন (লাল ও সাদা রং এর শার্ট পরিহিত) ব্যক্তিকে সক্রিয়ভাবে চামগাড়ী বিল নামক স্থানে সাঁওতালদের স্থাপনায় আগুন লাগাতে দেখা গেছে। অপরদিকে কুয়ামারা, সাহেবগঞ্জ ও হরিণমারী এলাকায় সাঁওতালদের নির্মিত স্থাপনায় কতিপয় স্থানীয় জনতা আগুন লাগিয়েছে।

গত ১৪ ডিসেম্বর গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল পল্লীতে অগ্নিসংযোগে পুলিশ জড়িত কি না সে বিষয়ে তদন্তের জন্য গাইবান্ধার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।

সাঁওতাল পল্লীতে গুলি চালানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত ১৬ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অ্যাসোসিয়েশন অব ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) এবং ব্রতী সমাজকল্যাণ সংস্থা একটি রিট আবেদন দায়ের করে। সাঁওতাল দ্বিজেন টুডোর স্ত্রী অলিভিয়া হ্যামভ্রম ও গনেশ মুরমো’র স্ত্রী রুমিলা কিসকুর পক্ষে আলদা রিট করা হয়েছে।

গত ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের বিরোধপূর্ণজমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও সাঁওতালদের সংঘর্ষ থামাতে গুলি চালায় পুলিশ। এতে তিন সাঁওতাল নিহত হন, আহত হন অনেকে। পরে পুলিশ-র‌্যাব ওই দিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এক অভিযান চালিয়ে মিলের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে।



মন্তব্য চালু নেই