‘সাংসারিক কাজের মূল্য নির্ধারণ হলে জিডিপিতে বাড়বে নারীর অবদান’

প্রতিযোগিতার বাজারে পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে যেমনি বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ, তেমনি বেড়েছে অর্থনীতিতে অবদান। তবে নারীদের কাজের সিংহভাগই আর্থিক অংকে পরিমাপ করা হয় না। এর মধ্যে নারীর সাংসারিক ও গৃহস্থালি কাজ অন্যতম। গৃহস্থালি কাজে নারীরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় আট ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেও অর্থমূল্যে এটা পরিমাপ না। ফলে মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) তাদের অবদান অগোচরেই রয়ে যায়। তাই নারীদের সাংসারিক কাজসহ অন্যান্য গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারিত হলে জিডিপিতে নারীর অবদান বাড়বে বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নারীদের সাংসারিক কাজের ছায়ামূল্য নির্ধারণ করে তা জাতীয় আয়ে অন্তর্ভূক্ত করা দরকার। পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তা বাড়াতে স্বল্প সুদে ঋণ, উচ্চপদে নারীদের সুযোগ দেয়া, দক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা উচিৎ। এতে অর্থনীতিতে নারীদের অবদান বর্তমানের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে মনে করনে তারা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সাবেক নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে শ্রম বাজার, কৃষি, গৃহে ও অন্যান্য কাজে নারীরা যে হারে অবদান রাখছে তা জিডিপিতে স্বীকৃতি পায় না। অর্থাৎ বর্তমানে জাতীয় আয় যেভাবে হিসেব করা হয়, তাতে নারীর আয়ের ৭০ শতাংশের বেশি উপেক্ষিত।

তিনি বলেন, বর্তমানে ৮৭ শতাংশের বেশি পুরুষ শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে রয়েছে। কিন্তু নারী রয়েছে ৩৫ শতাংশের মতো। নানা প্রতিবন্ধকতায় তারা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে না। আর কর্ম করলেও তা জিডিপিতে অন্তভূর্ক্ত হয় না।

জিডিপিতে যেমনি নারীদের অবদান আর্থিক অংকে পরিমাপ করতে হবে, তেমনি তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন আনা দরকার বলে মনে করেন সিপিডির সাবেক এই নির্বাহী পরিচালক।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে বর্তমানে ১ কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার নারী কাজ করছেন। এর মধ্যে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত কৃষিতে ৯০ লাখ ৮ হাজার বা ৪৫ শতাংশ, শিল্পে ৩৯ লাখ ৯৩ হাজার বা ৩৪ শতাংশ ও সেবায় ৩৮ লাখ ৪৬ হাজার বা ২১ শতাংশ নারী কর্মরত।

উৎপাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেকই নারী। এদের সিংহভাগই শ্রমিক। তবে নারী উদ্যোক্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপকসহ বিভিন্ন উচ্চপদের সংখ্যাও বাড়ছে দ্রুত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ চেয়ারম্যান ও নির্বাহীর দায়িত্বও পালন করছেন অনেকে। এছাড়া শিক্ষক, নির্মাণকর্মী, ব্যাংকার, শিল্পী, গণমাধ্যমকর্মী প্রায় সব পেশায় রয়েছেন। তবে কর্মজীবী নারীদের অর্ধেকেরও বেশি কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

অন্যদিকে দেশের তৈরি পোশাক খাতে অধিকাংশ নারী শ্রমিক থাকলেও উচ্চপদে নারীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে উচ্চপদে এই সংখ্যা বাড়ালে জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান খুব দ্রুত বাড়বে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, পোশাক খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে, যাদের ২৮ লাখই হচ্ছে নারী কর্মী।

এ বিষয়ে আবু আহমেদ বলেন, বাজার মূল্যে হিসাব করলে জাতীয় আয়ে পুরুষের অবদান ৬০ শতাংশ হলে নারীর হবে ৪০ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে নারীর অবদান ধরা হয় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। তবে আগামী অর্থনৈতিক শুমারীতে পরিবারে নারীর কাজের ছায়ামূল্য নির্ধারণ করলে এই আয় অনেক বেড়ে যাবে।

বিবিএসের তথ্যমতে, ২০০১ থেকে ২০০৩ সালে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশ গ্রহণ ছিল ১২ লাখ ২৯ হাজার ৪২৩ জন। ২০১৩ সালে ২৮ লাখ ২২ হাজার ৩০৫ জন বেড়ে তা দাঁড়ায় ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৭১৮ জনে। অর্থাৎ গত ১০ বছরে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশ গ্রহণ বেড়েছে ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত তিন বছরে এই সংখ্যা আরো বেড়েছে বলে জানা গেছে।

কর্মক্ষেত্রে নারীর দ্রুত বর্ধনশীলকে অর্থনীতির শক্তিশালী উপকরণ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ।

চ্যানেলই আই অনলাইনকে তিনি বলেন, বর্তমানে শ্রমখাতে ৩৩ শতাংশ নারী জড়িত। যাদের সিংহভাগই কৃষিতে। আর ৬৭ শতাংশ নারী রয়েছে কর্ম পরিধির বাইরে। কিন্তু নারীদের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগালে ৩৩ শতাংশ থেকে এই হার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশে উন্নীত করা যাবে।

তিনি বলেন, সিংহভাগ নারী বাইরে কাজ না করলেও সাংসারিক কাজে সারা জীবনই যুক্ত থাকেন। কিন্তু তাদের এ কাজের মূল্যায়ন জাতীয়ভাবে এখনও নির্ধারণ করা হয়নি।

এ বিষয়ে বিবিএসের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কর্মজীবী নারীরা শুধু বাইরে কাজ করেন তা নয়। রান্নাবান্না, ঘরের যাবতীয় বিষয় সমাধান করা, শিশু পরিচর্যাসহ গৃহস্থালির সব কাজও করেন। আর কর্মজীবী ছাড়া অন্যান্য নারীরা সংসারে প্রায় ১৫ ঘন্টা কাজ করেন। কিন্তু এর জন্য কোনো মজুরি পান না তারা।

ফলে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এর স্বীকৃতিও নেই। এর ফলে অর্থনীতিতে নারীর সাংসারিক কাজের অবদান আড়ালেই থেকে যায়। অথচ বাংলাদেশে ১ কোটি ৬ লাখেরও বেশি লোক গৃহস্থালির কাজ করেন। যাদের সিংহভাগই নারী।

তবে চলতি বছরে নারীদের সাংসারিক কাজকে শ্রমের বাজার মূল্যে হিসাব করে তা জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

বিবিএসের এই কর্মকর্তাকে সমর্থন করে নাজনীন আহমেদ বলেন, নারীদের বড় একটা অংশ পরিবারে কাজ করেন। কিন্তু তারা আনপেইড (অবৈতনিক)। এটি জাতীয় আয়ে হিসেব হয় না।

তিনি বলেন, শুধু শিক্ষায় উপবৃত্তি দিলেই হবে না। নারী শ্রমিকদের দক্ষ করে তোলার পাশাপাশি সুদবিহীন ছোট অংকের (দশ বা বিশ হাজার) ঋণ দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে তারা ঘরে বসে ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করতে পারে।

সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ২০০১ থেকে ২০০৩ সালে এক লাখ ৩ হাজার ৮৫৮ জন নারী ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালে চার লাখ ৫৯ হাজার ৫১০ জন বেড়ে তা দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ৬৩ হাজার ৩৬৮ জনে। অর্থাৎ গত ১০ বছরে ব্যবসায় নারীর অংশ গ্রহণ বেড়েছে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।

নারীরা এখন আর ছোট পরিসরে নয়, তারা শিল্পায়নে ঝুঁকছে। তাই এই সংখ্যা গত তিন বছরে (২০১৪-১৬) আরো অনেক বেড়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী।

তিনি বলেন, চাকরিতে প্রবেশের পাশাপাশি উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি নারীরা এখন বেশি উদ্যোগী। তারা এখন বড় শিল্পের দিকে এগুচ্ছে। এতে নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তনও এসেছে।

বর্তমান সরকার নারী উন্নয়ন অগ্রণী ভূমিকা রাখছে উল্লেখ করে এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, ৯৫ শতাংশের বেশি নারী ব্যাংক থেকে জামানতবিহীন ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করেন। তাই শিল্পায়নে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে এক অংকের সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।খবর চ্যানেল আই’র।



মন্তব্য চালু নেই