সাকিব-মুশফিক বীরত্বে সোনায় মোড়ানো একটি দিন

অবিশ্বাস্য! রোমাঞ্চকর! রূপকথা! সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহীমের কীর্তি বোঝাতে যেনো শব্দভাণ্ডারই ফুরিয়ে যাবে! তবু শেষ হবে না তাদের কল্যাণে আসা বাংলাদেশ ক্রিকেটের সোনায় মোড়ানো একটি দিনের গল্প। যে গল্পের শুরু হয়েছিল মুমিনুল হককে হারানোর বিষাদের মধ্য দিয়ে, আর শেষ হয়েছে সাকিবের ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিতে টাইগারদের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ টেস্ট ইনিংসের মালিক হওয়ার মধ্য দিয়ে। সঙ্গে মাঝখানে আছে ৩৫৯ রানের মহাকাব্যিক এক রেকর্ড জুটি রূপকথা।

ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে শুক্রবার প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৩৬ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ৫৪২ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ে দ্বিতীয় দিন শেষ করেছে বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডের বোলারদের কাঁদিয়ে সাকিব-মুশফিক এদিন যেকোনো উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ৩৫৯ রানের রেকর্ড জুটি গড়েছেন। দিনের শুরুতেই মুমিনুল হকের (৬৪) বিদায়ে যে বিপদের আভাস চোখ রাঙাচ্ছিল, সেটি তাসমানিয়া সাগরে কবর দিয়েছেন দুজনে। তার আগে সাকিব ২১৭ ও মুশফিক ১৫৯ রানের ঝলমলে কাব্যিক ইনিংস উপহার দিয়েছেন।

ওয়েলিংটনের সবুজ পিচের জুজু কেটে গেছে প্রথম দিনেই। বাংলাদেশের সামনে ছিল রান বন্যার হাতছানি। দিনশেষে সেটি অর্জনের প্রতিশব্দ হয়ে থাকল। দ্বিতীয় দিনের সকালে ৩ উইকেটে ১৫৪ রানে শুরু করেছিল সফরকারীরা। দুই অপরাজিতের একজন মুমিনুল (৬৪) আগের দিনের সংগ্রহের সঙ্গে কোনো রান যোগ না করেই সাজঘরে হাঁটা দেন। টিম সাউদির বলে উইকেটের পেছনে বিজে ওয়েটলিংকে ক্যাচ দিয়েছেন তিনি।

সেখান থেকে বাকি গল্পটুকু সাকিব আর মুশফিকের। ব্যক্তিগত ৫ রানে থাকা আরেক অপরাজিত সাকিব পাল্টা তোপ দাগেন মুশফিককে নিয়ে। পঞ্চম উইকেটে দুজন ৩৫৯ রানের রেকর্ডের এক জুটি গড়ে কিউই বোলারদের ঘাম ছুটিয়েছেন। যেটি টেস্টে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ট্রিপল সেঞ্চুরির জুটি। প্রথমটি ৩১২ রানের। খুলনায় ২০১৫ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে ইমরুল কায়েস ও তামিম ইকবাল যেকোনো উইকেট জুটিতে বাংলাদেশের আগের সর্বোচ্চ এই রানের জুটিটি গড়েছিলেন। সেটি ছিল উদ্বোধনী জুটিতে। পঞ্চম উইকেটে সাকিব-মুশফিকের জুটিই এখন বাংলাদেশের সেরা!

সোনায় মোড়ানো দিনে প্রথমে সেঞ্চুরির দেখা পান সাকিব। ক্যারিয়ারের চতুর্থ টেস্ট সেঞ্চুরি এসেছে প্রায় ২৬ মাস পর! সাকিব সাদা পোশাকে সর্বশেষ সেঞ্চুরিটি করেছিলেন ২০১৪ সালের নভেম্বরে। নেইল ওয়াগনারের করা ৯০তম ওভারের পঞ্চম বলে সিঙ্গেল নিয়ে মাইলফলক পূর্ণ করেন টাইগার অলরাউন্ডার। ১৫০ বলে ১৩টি চারের সাহায্যে শতকে পৌঁছান তিনি।

পরে সেটিকে ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিতে রূপ দিয়েই থামেননি সাকিব। বাংলাদেশের হয়ে তামিমের (২০৬) আগের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ টেস্ট রানের ইনিংসকে টপকে শিখরে পৌঁছেছেন। সাকিবের আগের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ টেস্ট ইনিংসটি ছিল ১৪৪ রানের। ২০১১ সালে মিরপুরে পাকিস্তানের বিপক্ষে এই ইনিংসটি খেলেছিলেন। অন্যদিকে তার আগে মুশফিক ও তামিমেরই কেবল বাংলাদেশি হিসেবে দ্বিশতক ছোঁয়ার কীর্তি ছিল। ২০১৩ সালে মুশফিক(২০০) ও ২০১৫ সালে তামিম(২০৬) টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন।

এদিন কলিন গ্র্যান্ডহোমের করা ইনিংসের ১২৫তম ওভারে ২৫৩ বলে ৩০ চারে ডাবল সেঞ্চুরি ছুঁয়ে ফেলেন সাকিব। পরে সাজঘরে ফেরার আগে ৩২ চারে ২৭৬ বলে ২১৭ রানে থেমেছেন টাইগারদের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।

তার আগেই তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারের দেখা পাওয়ার দিনে রেকর্ড বইয়ে আরো কিছু ওলট-পালট করেছেন এই তারকা। ব্যক্তিগত ৭১ রানে পৌঁছার মধ্য দিয়ে তামিম ও হাবিবুল বাশারের পর তৃতীয় বাংলাদেশি হিসেবে টেস্টে ৩ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন সাকিব। পরে সাকিবময় দিনে যখন ৯৮ রানে পৌঁছালেন, তখন বাশারকে (৩০২৬) পেছনে ফেলে বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক বনে যান এই বাঁহাতি।

এদিন আরো একটি অসাধারণ অর্জনের পাশে নাম লিখিয়েছেন সাকিব। বসেছেন কিংবদন্তিদের পাশে! সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ১৪তম ক্রিকেটার হিসেবে ৩ হাজার রান ও ১৫০ উইকেটের ডাবলসের কীর্তি গড়েছেন টাইগার অলরাউন্ডার। টেস্টে ১৫৯ উইকেট নিয়ে নিউজিল্যান্ড সফরে যান সাকিব। শুক্রবার ওয়েলিংটন টেস্টের দ্বিতীয় দিন মধ্যাহ্ন বিরতির পরপরই তিন হাজার ছুঁয়ে পৌঁছে যান টেস্টের এই অভিজাত ক্লাবে।

কিংবদন্তিদের এই ক্লাবে আগ থেকেই রয়েছেন ১৩জন তারকা। স্যার গ্যারি সোবার্স, ইমরান খান, জ্যাক ক্যালিস, ইয়ান বোথাম, রিচার্ড হ্যাডলি ও কপিল দেবের মতো কিংবদন্তিরা টেস্টে এই ডাবলস অর্জনের পাশে নাম লিখিয়েছেন। তালিকায় আছেন শন পোলক, রবি শাস্ত্রী, চামিন্ডা ভাস, শেন ওয়ার্ন, ড্যানিয়েল ভেট্টরি, ক্রিস কেয়ার্নস ও অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের মতো কিংবদন্তি ক্রিকেটাররাও।

সাকিবময় দিনে ভুলে গেলে চলবে না মুশফিককে! কেন উইলিয়ামসনকে ডাউন দ্য উইকেটে ছক্কা মেরে তিনিই টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জুটির অঙ্কটি চিত্রিত করেছেন! তার আগে ২৮ মাস পর সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন মুশফিক। মিডলঅর্ডারের এই ভরসা রানেই ছিলেন। কেবল ইনিংসগুলোকে সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে পারছিলেন না! ওয়েলিংটনে তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করে সেই আক্ষেপই দূর করেছেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক। এর আগে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে কিংসটাউনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শেষবার সেঞ্চুরির জন্য ব্যাট উঁচিয়ে ধরেছিলেন মুশফিক। পরে কেটে গেছে ১১টি টেস্ট।

টাইগারদের উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান টিম সাউদির করা ৯৬তম ওভারের দ্বিতীয় বলে দারুণ চার হাঁকিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন। ১৭৮ বলে ১৭টি চারের সাহয্যে ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরিতে পৌঁছেছেন তিনি। ৮২.২ ওভার স্থায়ী রেকর্ড জুটি গড়ে ফিরে গেছেন মুশফিকুর রহিম। ১৫৯ রানে ট্রেন্ট বোল্টের অফস্টাম্পের বাইরের বলে উইকেটের পেছনে ওয়েটলিংকে ক্যাচ দিয়েছেন টাইগার অধিনায়ক। নিজের ইনিংসটি ২৩ চার ও ১ ছয়ে ২৬০ বলে সাজিয়েছেন মুশি।



মন্তব্য চালু নেই