সার্ক নেতারা যে যা বললেন

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) দুই দিনব্যাপী (২৬-২৭ নভেম্বর) ১৮তম শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে। সার্কভুক্ত আটটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের উপস্থিতিতে বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর সিটি হলে শীর্ষ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ও সার্কের বিদায়ী চেয়ারপারসন আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম।

এরপর সার্কভুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা তাদের বক্তব্য দিতে শুরু করেন।
উদ্বোধনী ভাষণে নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কেরালা সার্কের দেশগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলের মানুষের উন্নয়ন জন্য ও গণতন্ত্রের জন্য সার্ককে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।’

তিনি সার্ক দেশগুলোর মানবসম্পদের সঠিক ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

সন্ত্রাসবাদকে সার্ক অঞ্চলের মূল সমস্যা আখ্যায়িত করে সুশীল কেরালা বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ আমাদের সকলের জন্য একটি সমস্যা। দক্ষিণ এশিয়া সন্ত্রাসবাদের সমস্যায় জর্জরিত। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সমঝোতা করা মানে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের ধ্বংসের সঙ্গে সমঝোতা করা। এটি শান্তি, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পথে মূল বাধা। তাই আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে সার্কের দেশগুলোতে উন্নয়ন ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করতে হবে।’
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ তার বক্তৃতায় একসাথ হয়ে রোগ, দারিদ্র্য, অশিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা জানান।

নওয়াজ শরিফও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শক্ত লড়াই করার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন করতে হবে। এজন্য সার্কের সব দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া সন্ত্রাসবাদ দূরীকরণ সম্ভব নয়।’
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে সার্কের চলমান সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সার্ককে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠায় বৈষম্য দূর করতে হবে। গ্রাম্য ও অনগ্রসর অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।’

সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর ওপর জোর দেন রাজাপাকসে। এজন্য তিনি সাফটা কার্যকর করার কথা বলেন।
রাজাপাকসে বলেন, ‘সাফটা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে হবে।’
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সার্ককে আরো অগ্রসর ও কার্যকর অবদান রাখার আহ্বান জানান তিনি। এ ছাড়া আঞ্চলিক উদ্যোগের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের কথাও বলেন।

তিনি বলেন, ‘সার্কের দেশগুলোতে শান্তিপ্রিয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বসবাস। তাই এ অঞ্চলে মানবাধিকার রক্ষা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমলাতান্ত্রিকতার অবসান ঘটাতে হবে এই সম্মেলনের মাধ্যমেই।’

আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আফগানিস্তান সবসময়ই বদ্ধ পরিকর। এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তান সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গে কাজ করবে।’
তিনি জানান, গ্যাস, তেল পাইপ লাইন স্থাপনসহ সার্ক দেশগুলোর অবকোঠামোগত উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হলো আঞ্চলিক সহযোগিতা।’

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সার্কের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ক্ষুধা ও দারিদ্র্য।’
স্বাস্থ্য, কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তনসহ সার্কভুক্ত দেশগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, `দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে বাংলাদেশ সরকার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সার্বিক শান্তি, উন্নতি ও স্থিতিশীলতার জন্য পরস্পরের মধ্যে ভৌত কানেকটিভিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক মোটরযান পরিবহণ চুক্তি ও রেল পরিবহণ চুক্তি হলে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে।

তিনি বলেন, ‘কানেকটিভিটিকে বাংলাদেশ বিস্তৃত পরিসরে চিন্তা করে। আমরা পারস্পরিক আইডিয়া, জ্ঞান, প্রযুক্তি, সাংস্কৃতিক কানেকটিভিটি, জনগণের সঙ্গে জনগণের সংযুক্তি, সড়ক-রেল-আকাশপথে কানেকটিভিটি, পণ্য পরিবহণ, সেবা ও বিনিয়োগের কানেকটিভিটিতে বিশ্বাস করি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘সার্ক নেতাদের কাছে আমার প্রত্যাশা- একই মঞ্চে থেকে আঞ্চলিক কানেকটিভিটিকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করবেন।’

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে শান্তি স্থাপন, নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সন্ত্রাসবাদ নিরসনে কার্যকার পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সার্কের দেশগুলোর মধ্যে সদভাব স্থাপনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকার শুধু ভারত নিয়েই নয়, বরং সার্কের প্রতিটি দেশের উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করে।’

সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বিরাজমান পারস্পরিক সংশয় ও সন্দেহকে মোদি উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে অভিহিত করেন। হিন্দি প্রবাদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এক এক করে পাঁচ। কিন্তু পাঁচজন এক নই। আমাদের ভিতর সংশয় ও সন্দেহ অনেক বেশি। চলুন সার্কের উন্নয়নে আমরা সংশয়বাদকে আশাবাদে পরিণত করি।’

তিনি আরো বলেন, ‘ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর যাওয়ার চেয়ে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে যাওয়া কঠিন ও ব্যয়বহুল। এ থেকেই বোঝা যায় আমাদের মধ্যে সম্পর্ক কতটা শিথিল। এ সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে হবে। ভারত সার্কভুক্ত দেশগুলোর জনগণকে তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদী ভিসা দেবে, যাতে সার্কের অন্যান্য দেশের মানুষ ভারতে এসে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবা নিতে পারে।’

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন বলেন, ‘সার্ক কার্যকর করতে আরো উদ্যোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে এ সংস্থাভু্ক্ত দেশগুলোকে আন্তরিক হতে হবে। তাহলেই সার্ক শুধু এ অঞ্চলেই নয়, বরং সারা বিশ্বে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।’



মন্তব্য চালু নেই