সিএমপি কমিশনারসহ ৭ পুলিশের শাস্তির সুপারিশ

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে নিজেদের জালেই ফেঁসে গেছেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার, ওসি এবং এসআইসহ সাত পুলিশ কর্মকর্তা।

সিআইপি মর্যাদাধারী এক শিল্পপতি ব্যবসায়ীকে মিথ্যা মামলায় হয়রানির দায়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তদন্তে চট্টগ্রামের আলোচিত সাত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তসহ বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হকের নির্দেশে এই তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তদন্তে মিথ্যা মামলায় ব্যবসায়ীকে হয়রানির দায়ে ওই কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করা হয়। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার তদন্ত করেন ঢাকা পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ডিআইজি আলমগীর আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত দল।

অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা হলেন সিএমপির বায়েজিদ বোস্তামী থানার হয়রানিমূলক মামলার বাদী এসআই সুজন বিশ্বাস, একই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই একরামুল হক, মামলা রেকর্ডকারী থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস, নগর পুলিশের উত্তর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) দীপক জ্যোতি খীসা, অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শেখ শরিফুল ইসলাম, উত্তর জোনের উপকমিশনার (ডিসি) পরিতোষ ঘোষ, এবং সিএমপি কমিশনার আবদুল জলিল মন্ডল। অভিযুক্তদের মধ্যে মামলার বাদী এসআই সুজন বিশ্বাস, তদন্তকারী এসআই একরামুল হক ও মামলা রেকর্ডকারী ওসি প্রদীপ কুমার দাসকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অধস্তন কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড তদারকিতে গাফিলতির অভিযোগ এনে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের দায়েরকৃত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ৪ আগস্ট চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় অবস্থিত সুপার রিফাইনারি নামক একটি কারখানা থেকে ৯ হাজার লিটার কেরোসিন সলভেন্ট অয়েল নিয়ে একটি ট্যাংকলরি অন্য একটি কারখানায় যাওয়ার জন্য রাস্তায় নামে। ট্যাংকলরিটি কারখানা থেকে বের হয়ে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে গেলেই বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশের এসআই সুজন বিশ্বাসের নেতৃত্বে একদল পুলিশ লরিটি আটক করে। লরিতে অবৈধ তেল রয়েছে- এমন অভিযোগে আটকের পর সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ পুলিশকে তেল পরিবহণ এবং বৈধভাবে আমদানি করার যাবতীয় কাগজপত্র প্রদর্শন করে। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তা কোনো কথা না শুনেই লরির চালক, হেলপার এবং কারখানার একজন সুপারভাইজারসহ লরিটি আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে এই ঘটনায় সুপার রিফাইনারি কোম্পানির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অন্যান্য কর্মকর্তাসহ মোট ১০ জনের বিরুদ্ধে বায়েজিদ বোস্তামী থানার এসআই সুজন বিশ্বাস বাদী হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলা দায়েরের পর সুপার রিফাইনারি কারখানার চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী সেলিম আহাম্মেদ পুলিশের আইজিপি এ কে এম শহীদুল হকের কাছে সরাসরি লিখিত অভিযোগে জানান, তার মালিকানাধীন সুপার রিফাইনারি কারখানাটি একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। কারখানা থেকে অন্য কারখানায় পরিবহণের সময় বৈধ তেলবাহী ট্যাংকলরি আটক করে মিথ্যা ধারায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করেছে শুধু হয়রানি করার জন্য। মামলা দায়েরের পর উদ্দেশ্যমূলকভাবে কারখানার মালিক এবং অন্যান্য কর্মকর্তার গ্রেফতারে কারখানা, বাসা ও অফিসে একাধিকবার অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। কারখানার কোনো ঘটনায় মালিক কিংবা কর্মকর্তাদের দায়ী করা যায়। কিন্তু আলোচিত এই মামলায় কারখানার মালিকের পরিবারের সদস্যদেরও জড়ানো হয়েছে।

এই অভিযাগের ভিত্তিতে আইজিপি শহীদুল হক হেডকোয়ার্টার্সের ডিআইজি আলমগীর আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটির মাধ্যমে দ্রুত সময়ে ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত প্রতিবেদন গত ৩ সেপ্টেম্বর আইজিপির দপ্তরে জমা দেওয়া হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে সিএমপির সাত পুলিশ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে বলা হয়, বায়েজিদ বোস্তামী থানার এসআই সুজন বিশ্বাস ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫-বি ধারায় মামলা করলেও সেই মামলায় ওই অপরাধের ধারার কোনো উপাদান সন্নিবেশিত করেননি। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার ও কর্তব্যে চরম অবহেলা প্রদর্শন করেন, যা অসদাচরণের শামিল। আর বায়েজিদ বোস্তামী থানার এসআই একরামুল হক আসামিদের হয়রানি করার অসৎ উদ্দেশ্যে নিরপেক্ষভাবে কোনো যাচাই-বাছাই না করে, তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই আসামিদের বাড়ি ও অফিসে গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে কোম্পানির প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের হয়রানি করেছে। মামলাটির ধারা ভুল হলেও তা সংশোধনের উদ্যোগ নেননি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাসের সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানের আগে থেকেই যোগাযোগ থাকলেও তদন্তকালে তিনি উল্টো মিথ্যা তথ্য দিয়ে অসদাচরণ করেছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম উত্তর জোনের সিনিয়র এসি দীপক কুমার জ্যোতি খীসা তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মামলার ধারা, মামলার তদন্ত ও হয়রানিমূলক গ্রেফতার সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা প্রদান করেননি। যা অধীনস্থদের তদারকিতে গাফিলতি। উত্তর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শেখ শরিফুল ইসলাম মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে মামলাটির সামগ্রিক বিষয়সংক্রান্ত সঠিক দিকনির্দেশনা না দিয়ে অধীনস্থদের নিয়ন্ত্রণহীন কর্মকাণ্ডে সমর্থন করেছেন। উত্তর জোনের ডিসি পরিতোষ ঘোষ মামলাটির কপি হাতে পাওয়ার পর তা যথাযথভাবে পর্যালোচনা না করে সুপার রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যাচাই-বাছাই ব্যতীত ভুল ধারায় মামলা রুজু ও পরবর্তী সময়ে আসামি গ্রেফতার অভিযান তদারকিতে গাফিলতি করেছেন। এ ছাড়া সিএমপি কমিশনার আবদুল জলিল মন্ডল তার অধীনস্থদের কার্যক্রমে তদারকি বা যথাযথ যাচাই-বাছাই না করে গাফিলতি করেছেন। যার জন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

হেডকোয়ার্টার্সের পুলিশি তদন্তে জানা যায়, যে ব্যবসায়ীকে হয়রানি করার জন্য বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে তিনি একজন সিআইপি (কমার্শিয়ালি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি)। তেলভর্তি যে ট্যাংকলরিটি পুলিশ আটক করেছিল। ওই ট্যাংকে থাকা তেলের জন্য ৫৫ হাজার ৩৫০ টাকা শুল্ক পরিশোধ করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এই শুল্ক পরিশোধের রসিদ পুলিশকে দেখানোর পরও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা তা আমলে নেননি। এই তেল আটকের ঘটনায় চোরাচালানি বা বিশেষ ক্ষমতার মামলার কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবদুল জলিল মন্ডল বলেন, ‘আলোচিত মামলাটি দ্রুত তদন্ত করে চার্জশিট দিতে গিয়ে পদ্ধতিগত ভুল হয়েছে। ফলে আদালতে মামলাটির চার্জশিট গৃহীত হয়নি। বর্তমানে এই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে।’

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে তার কিছু জানা নেই বলে তিনি জানান।



মন্তব্য চালু নেই