সিলেটে নারীরা যেভাবে চুরি করে

সিলেটজুড়ে গড়ে ওঠেছে নারী চোরচক্র। বিশাল ওই চক্রের সদস্যরা নগরীর বিভিন্ন মাকের্ট, মাজার এমনকি বাসা-বাড়িতে গিয়েও অভিনব সব কায়দায় চুরি সংগঠিত করে।

গত মঙ্গলবার বেলা দেড়টা । নগরীর জিন্দাবাজারস্থ আল হামরা শপিং সিটির চতুর্থতলার একটি সোনার দোকানে চুরির দুর্ধর্ষ এক ঘটনা ঘটায় চক্রটি। এসময় চার নারী ওই দোকান থেকে প্রায় ১৭ ভরি স্বর্ণ চুরি করে নিলেও চুরির সম্পূর্ণ ঘটনাটি ধরা পড়ে যায় ওই মাকের্টের সিটি ক্যামেরায়।

ক্যামেরার ভিডিওতে দেখে যায়, চারজন নারীর মধ্যে দুজন বোরকা পরা, একজন শাড়ি এবং অপরজন সালোয়ার-কামিজ পরা অবস্থায় ছিলেন। যিনি স্বর্ণভর্তি বক্সটি তুলে নিয়ে শাড়ির আঁচলের লুকিয়ে ফেলেন তিনি প্রথমাবস্থায় বসা ছিলেন। এদিকে, অপর দু’নারীকে স্বর্ণের চেইন দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন দোকানটির এক কর্মচারী। সালোয়ার-কামিজ পরা নারীটি কানের একজোড়া দোল কেনার আগ্রহ দেখালে দোল দেখানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন দোকানের অপর দুই কর্মচারী।
ঠিক এ সময় উঠে দাঁড়ান চক্রের মূলহোতা। যে সেলফটির মধ্যে ১৭ ভরি স্বর্ণভর্তি বক্সটি রাখা ছিল, ধীরে ধীরে ওই সেলফের সামনে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। তারপর দুঃসাহসিকতার সঙ্গে সেলফ টপকে বক্সটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে চট করে শাড়ির আচল দিয়ে ঢেকে ফেলে। এর কিছুক্ষণ পরই দোকান থেকে বেরিয়ে যায় দুই নারী। কয়েক সেকন্ডের মধ্যে অপর দুজনও বেরিয়ে যায়।

গোল্ড গার্ডেন জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী হাজী মো. আয়াতুল ইসলাম খান জানান, গত মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকেপৃথক দুইভাগে চারজন নারী তার দোকনে ঢুকে। এর মধ্যে সালোয়ার-কামিজ পড়া একজন সাড়ে ৬ হাজার টাকায়কানের একজোড়া দোল কেনার ছলে দোকানে থাকা ম্যানেজার-কর্মচারীসহ তিনজনের একজনকে ব্যস্ত রাখেন। বাকিদের মধ্যে দুজন স্বর্ণ কেনার ভান করে দোকানে থাকা অপর দুই কর্মচারীকে ব্যতিব্যস্ত রাখেন। এরই ফাঁকে শাড়ি পরা অপর নারী দুঃসাহসিকতার সঙ্গে দোকানের স্বর্ণ রাখার সেলফ টপকে ১৭ ভরি স্বর্ণভর্তি একটি বক্স তুলে নিয়ে শাড়িরআঁচল দিয়ে আড়াল করে ফেলেন। প্রায় আধাঘণ্টা তারা দোকানে অবস্থান করে ওই চার নারীর দুজন স্বর্ণালঙ্কার না কিনেই বেরিয়ে যায়। একটুপর মূলহোতাসহ অপরজনও হাসিমুখে বেরিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর ওই স্বর্ণভর্তি বক্সের কথা মনে পড়ে গোল্ড গার্ডেন জুয়েলার্সের ম্যানেজার অশোক কুমার সাহার। কিন্তু যথাস্থানে বক্সটি না দেখে মাথায় হাত দেয়া ছাড়া তখন আর কিছুই করার ছিল না তার।

এদিকে, অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেটে নারী চোরচক্রের হোতাদের মধ্যে বর্তমানে সক্রিয় আছেন- কমলা, সুমি, নাজমা, স্বপ্না, শান্তা, পপি, মাফিয়া, নাতাশা, শাইনি ও রোজিনা। তারা চুরি করতে গিয়ে কয়েকটি কৌশল অবলম্বন করে থাকে। তারা নগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী সেজে যান। সেখানে ‘টার্গেট’ ঠিক করে সেই টার্গেটের সঙ্গে একই লাইনে দাঁড়ায়। তারপর সুকৌশলে টার্গেটের ব্যাগ থেকে মোবাইল, টাকা কিংবা অন্যকোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হাতিয়ে নিয়ে দ্রুত সহযোগীর কাছে পাচার করে দেয়।

বিয়ের অনুষ্ঠানে চুরি : নগরীতে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এমন সেন্টারগুলোতে ওই নারীচোরচক্রের সদস্যরা কখনো বোরকা পরে আবার কখনো বোরকা ছাড়াই যায়। সেখানে গিয়ে তারা শিশুদের কোলে নিয়ে অথবা ডেকে আদর করার নাম করে কৌশলে তাদের গলার স্বর্ণের চেইন হাতিয়ে নেয়। এছাড়া, বিয়ের অনুষ্ঠানে বরের আগমন কিংবা কনে বিদায়ের সময় তরুণীরা যখন ভীড় করে, তখন তরুণীদের গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন সুকৌশলে হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেয় এ চক্রের সদস্যরা। চুরি শেষে সেখান থেকে পালানোর ধরনও অভিনব। অনুষ্ঠানস্থলে ঢোকার সময় বোরকা পরে গেলেও বের হওয়ার সময় তারা বোরকা খুলে বের হয়। অপরদিকে, ঢোকার সময় বোরকা ছাড়া গেলে বের হওয়ার সময় তাদের বোরকা পরে বের হতে দেখা যায়।

মাজারে চুরি : নগরীর শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরান (রহ.) মাজারেও নারীচোরচক্রের সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তারা নারীভক্তদের সঙ্গে মাজারে গিয়ে উপস্থিত হয়। পরে পূর্ব থেকে টার্গেটকরা নারীদের হাতব্যাগ থেকে মোবাইল, টাকা ছিনিয়ে নেয় এ চক্রের সদস্যরা। পরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাজারে আসা ভক্তদের সঙ্গে মিশে যায় চোরচক্রের এসব সদস্য।

ট্রেনে চুরি : এসব নারীচোরচক্রের সদস্য ট্রেনেও হানা দেয়। সিলেট থেকে ট্রেন ছেড়ে যাওয়া সময় তারা যাত্রী বেশে ট্রেনে উঠে তাদের কাঙ্ক্ষিত যাত্রীকে টার্গেট করে। ট্রেন ছেড়ে দেয়ার পর চক্রের সদস্যরা এক বগি থেকে অন্য বগিতে গিয়ে টার্গেটকৃত যাত্রীর কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে সুযোগ বুঝে গলার স্বর্ণের চেইন, মোবাইল, টাকাসহ বিভিন্ন মাল চুরি করে  মাঝপথে নেমে যায়। সিলেট থেকে ট্রেনে উঠা চোরচক্রের সদস্যরা কাজ হাসিল করে শায়েস্তাগঞ্জে গিয়ে নামে। আর শায়েস্তাগঞ্জ থেকে উঠা চক্রের সদস্য গিয়ে নামে মোগলাবাজারে।

তাছাড়া, রাত একটু ঘনিয়ে এলে নারী চোরচক্রের সদস্যরা নগরীর কিনব্রিজের সামনে অবস্থান নেয়। এসময় তারা সেতু পারাপাররত পুরুষদের ঘিরে ধরে আপত্তিকর ছবি তুলে টাকা ও মোবাইলফোন হাতিয়ে নেয়। কিনব্রিজ ছাড়াও এসব নারী দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতা আছে সুরমা পয়েন্ট, কদমতলী বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন ও ওসমানী শিশু পার্ক এলাকায়।

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার রহমত উল্লাহ বলেন, ‘সিলেটে নারীচোরসহ সব ধরনের অপরাধী ধরতে পুলিশ তৎপর আছে। এছাড়াও নারীচোরচক্রের সদস্যদের ধরতে নগরীর বিভিন্ন মাকের্টে বা গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সাদা পোশাকধারীরা কাজ করছে।’



মন্তব্য চালু নেই