সুন্দরী শূন্য হবে সুন্দরবন!

সুন্দরবনের নামই হয়েছে সুন্দরীদের জন্য! মানে সুন্দরী নামে গাছের জন্য। আর সেই সুন্দরী গাছই কিনা আর থাকবে না! এমনটাই বলছেন জলবায়ু ও দুর্যোগ বিষয়ে কাজ করা গবেষক, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের ঝুঁকি ও ক্ষতি মোকাবেলা করে উদ্যোগ না নিলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে সুন্দরবনে কোনো সুন্দরী গাছ থাকবে না। ওই এলাকার মানুষ নানা শারীরিক অসুস্থতায়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়বেন। বালাদেশ এই ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকার মূল কারণ দুর্যোগ ও জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করতে না পারা ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাব। বৈশ্বিক দরবারে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি কিংবা সমস্যা সঠিকভাবে উপস্থাপন না করার করণেও দুর্যোগ ও জলবায়ু পরির্তনের ফলে ভবিষ্যতে মারাত্মক ঝুঁকিতে পরবে বাংলাদেশ।

শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় ওয়ারশ আন্তর্জাতিক পদ্ধতি বিষয়ক কর্মশালা’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবেলায় জাতীয় কর্মপরিকল্পনার প্রস্তাব উত্থাপনের উদ্দেশ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, এনএসিওএম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং একশনএইড বাংলাদেশ দু’দিনের এই কর্মশালার আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষ নিত্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এ সমস্যার সমাধান তাই অতীব জরুরী। প্রয়োজন দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস তহবিল গঠনের। ২০১৬ সালে সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসের সকল আলোচনা এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় দরকষাকষিতে ক্ষয় ও ক্ষতির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাবে। আবার এই বছরই ‘ক্ষয় ও ক্ষতি’ বিষয়ক ওর্য়াশ আন্তর্জাতিক দলিলের কর্ম পরিকল্পনার উপর দ্বিবার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। যার ভিত্তিতে এই দলিলটিকে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে’।

মন্ত্রী উল্লেখ করেন, ‘১৯৯৮ সাল থেকে পাঁচটি বড় মাপের দুর্যোগের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাংলাদেশের মোট জিডিপির প্রায় ১৫ শতাংশ। এসব দুর্যোগ জলবায়ূ পরিবর্তনের একটি নেতিবাচক প্রভাব – আগামী বছরগুলোতে যা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। দুর্যোগ মোকাবেলার পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিরুপনে সরকারী, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা, গবেষক সবাইকে নিযে একসঙ্গে কাজ করতে হবে’।

অনুষ্ঠানে আলোচকরা বলেন, ‘এ বছেরর ডিসেম্বরে বিশ্বের ৫০ উন্নয়নশীল দেশ জলবায়ু ও পরিবেশগত পরিবর্তনের ক্ষতি নিরুপণ করে বৈশ্বিকভাবে দাবি তুলে ধরা হবে। সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ যদি সঠিকভাবে দাবি তুলে ধরতে না পারে, তাবে আন্তর্জাতিভাবে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিবেশ ও জলবাযূ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘জলবায়ু ও দুর্যোগ মোকাবেলায় যদি সঠিকভাবে কাজ না করা হয়, তবে আগামী ২০ বা ৩০ বছরের মধ্যে সুন্দরবনে কোন সুন্দরী গাছ থাকবে না। এখনই ওই এলাকার মানুষকে লবণাক্ততার কারণে পানি কিনে খেতে হয়। যে কারণে যতটুকু ভাল পানি তাদের পান করা দরকার, সেটি তারা পারছে না। এরকম চলতে থাকলে, তারা কিডনি সমস্যাসহ নানা শারীরিক সমস্যায় পারবেন’।

তিনি আরো বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সেটি এখনো নিরুপিত হচ্ছে না। নেই সম্মিলিত কোন উদ্যোগ। মানুষের আর্থিক, সামাজিক, শারীরিক ও মানুষিক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের একটা দাবি ছিল, দুর্যোগের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্য ইন্সুরেন্সের ব্যবস্থা করা। ১৯৯২ সালে প্রথমবারের মত জলবায়ূও ক্ষতি মোকাবেলায় বৈশ্বিক লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্য আমাদের, এত বছর পরও আমরা আমাদের ক্ষতির মাত্রা নিরুপণ করতে পারিনি। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে এটা করা খুবই জরুরি’।

দুর্যোগ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. সালিমুল হক বলেন, ‘ডিসেম্বরে মরোক্কতে অনুষ্ঠেয় বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির দাবি তুলে ধরতে হবে। যতটুকু সময় আছে তার মধ্যেই আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। সেখানে আমাদের প্রস্তাব উত্থাপন করতে হলে ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন। ক্ষয় ও ক্ষতির জন্য দায়ীরা কেন ক্ষতিপূরণ দিবে তার জন্য যুক্তি উপস্থাপন করার জরুরি’।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান সন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ্ কামাল বলেন, “আমরা নিজেরা সংগঠিত না। দুর্যোগের ফলে যে ক্ষতি হচ্ছে তার দায় আমাদের না। এজন্য উন্নত দেশগুলো দায়ী। তাদের কাছে আমাদের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে। আর সেটি শক্তভাবে করতে হলে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নির্ণয় করতে হবে। আমরা সেটি করতে পারছি না। জলবায়ূ বা দুর্যোগ ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে আমরা ভালভাবে উপস্থাপন করতে পারছি না। এর মূল করাণ আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করছি না। স্বাধীতার ৪৫ বছর হলো। কিন্তু দুর্যোগ ও জলবায়ূ ইস্যুতে আমরা শক্ত অবস্থানে যেতে পারি নি।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘জলবায়ু ও দুর্যোগ নিয়ে সবার মধ্যে পরিষ্কার ও শক্ত ধারণা তৈরি করতে হবে। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের জন্য একসঙ্গে উদ্যোগ নিতে হবে। সেটি না করতে পারলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষরা অর্থনৈতক, সামাজিক ও শারীরিকভাবে আরো বেশি সমস্যায় পড়বেন’।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের ফলে শুধুমাত্রা আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি হচ্ছে না। একজন মানুষের মানুষিক, শারীরিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করতে, এই বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা উচিৎ’।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাবের পেছনে একটি প্রধান কারণ হিসেবে রয়েছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য জলবায়ু দুর্যোগ তীব্র আকার ধারণ করছে। এর বিরূপ প্রভাব পরবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর মানুষের জীবন, অর্থনীতি এবং পরিবেশের উপর। এটা উল্লেখযোগ্য যে, উনড়বত ও উনড়বয়নশীল দেশগুলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য সম্মত হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব চিহ্নিতকরণ, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য অর্থনৈতিকভাবে সহায়তারও অঙ্গীকার করেছে উন্নত দেশগুলো।



মন্তব্য চালু নেই