সুমিকে ৭ টুকরা করা হয় যে কারণে

রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় সুমি (২৩) নামের তরুণীকে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে নৃশংসভাবে লাশ সাত টুকরো করা হয়। এর পরও থামেনি ঘাতকদল, কেউ যাতে চিনতে না পারে সেজন্য আগুন দিয়ে তার মুখমণ্ডল ঝলসে দেওয়া হয়।

সুমি কিছুদিন পুলিশ ও র‌্যাবের সোর্স হিসেবে কাজ করেছেন। সোর্স হিসেবে কাজের আগে তিনিও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পুলিশ ও র‌্যাবের সোর্স হিসেবে কাজ করাই এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ হতে পারে বলে সন্দেহ করছেন গোয়েন্দারা। তাদের ধারণা, পরিচয় লুকাতেই সাত টুকরা করা হয়েছে সুমিকে।

এ ব্যাপারে যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম জানান, ফকিরাপুল এলাকায় দীর্ঘদিন যাবৎ সুমি হত্যা মামলার আসামি সুজন, রাতুল, শাওন, মিকি মাউস আলম, তোতলা সুমন, বাংলা সোহেল, হানিফ, কালু ও কানন দে তাদের দলনেতা মো. সাইদুল ইসলামের নেতৃত্বে ইয়াবা ও হেরোইনের ব্যবসা করে আসছিল। এরা প্রত্যেকেই মোবারক হোসেন মন্টির বাসার ছাদে বসে প্রতিদিনই ইয়াবা সেবন করত। সুমি তাদের পূর্বপরিচিত। সুমি নিজেও মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মাদক ব্যবসা ছেড়ে পুলিশ-র‌্যাবের সোর্স হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি তার স্বামী নাসির উদ্দিনকেও মাদক ব্যবসার পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালান।

সুমিকে খুন করার কারণ

যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) বলেন, ‘সুমি পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করার সময় সাইদুল ও মন্টিকে কয়েকবার ইয়াবাসহ পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়। এর পর থেকেই সাইদুল ও মন্টির সঙ্গে সুমির বিরোধের সৃষ্টি হয়। ঘটনার চার-পাঁচ দিন আগে সুমির স্বামী নাসির ইয়াবাসহ পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন। সুমি এই ঘটনার জন্য সাইদুল, সুজন, হানিফ ও মন্টিকে দায়ী করে এবং বিষয়টি বিভিন্ন জনের কাছে বলে বেড়ায়। তাদের পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করে। এতে তারা সুমির ওপর ক্ষুব্ধ হয়। ঘাতকদের কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য সুমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ফাঁস করতে পারে- এমন আশঙ্কায় তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।’

যেভাবে খুন করা হয় সুমিকে

গত ৯ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় সুজন, রাতুল, শাওন, মিকি মাউস আলম, তোতলা সুমন, বাংলা সোহেল, হানিফ, সাইদুল সবাই মন্টিদের বাসার ছাদে ইয়াবা সেবন করছিল। সুমি তখন ঐ বাসার নিচে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। এক পর্যায়ে সুজন ওপর থেকে সুমিকে দেখে ফেলে এবং সাইদুলকে বলে, ‘বস, সুমি পুলিশ নিয়া আমাদেরকে ধরাইতে আসছে।’
এরপর সুজন, হানিফ, নুরুন্নবী শাওন, সাইদুল নিচে নেমে এসে সুমিকে ধরে ফেলে। শাওন কোলে তুলে নেয় আর বাকিরা কেউ মুখ চেপে ও কেউ হাত-পা ধরে মন্টির বাসার ছাদে চিলেকোঠায় নিয়ে যায়। তারা সবাই মিলে সুমিকে লোহার অ্যাঙ্গেলের সঙ্গে নাইলনের রশি দিয়ে বাঁধে। সুজন কাগজ মুড়িয়ে, স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে বল বানায়। ওই বল সুমির মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয়। মন্টি পরে সুমিকে জোরপূর্বক ইয়াবা সেবন করায়।

এরপর সুমিকে রাত আনুমানিক আড়াইটা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে সাইদুল ইসলাম ও সুজন তাদের সঙ্গে থাকা ছুরি দিয়ে গলায় পোঁচ দিয়ে হত্যা করে। মোবারক হোসেন মন্টি তার বাসা থেকে চাপাতি ও রেতের একটি ছুরি নিয়ে আসে। মোবারক হোসেন মন্টি চাপাতি দিয়ে সুমির মাথাকে দেহ থেকে আলাদা করে। সুজন ডান পা কাটে। রাতুল বাঁ পা কাটে। সাইদুল ও বাংলা সোহেল ডান হাত কাটে। হানিফ বাঁ হাত কাটে। মিকি মাউস আলম ছুরি দিয়ে সুমির পেটে আঘাত করে।

বাংলা সোহেল ডান ও বাঁ হাত দুটি ওয়াসার খালি জায়গায় ফেলে দেয়। সুজন ডান পা ও বাঁ পা হোটেল উপবন ও মোবারক হোসেন মন্টির বাসার চিপায় ফেলে দেয়। মোবারক হোসেন মন্টি তার ঘর থেকে কেরোসিন তেল এনে আগুন দিয়ে সুমির মাথাটা পোড়ায়, যাতে কেউ চিনতে না পারে। সাইদুল, শাওন, সুমন, বাংলা সোহেল, রাতুল, হানিফ মোবারক হোসেন মন্টি, আলম, সুজন সবাই মিলে চাদর দিয়ে সুমির দেহ পেঁচিয়ে ছাদ থেকে নিচে নামিয়ে ওয়াসার টিনশেড ঘরের চালের ওপর ফেলে দেয়।

মন্টির ঘর থেকে বালতি ও মগ এনে সুমন ও আলম পানি দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে। তখন ফজরের আজান ভেসে আসছিল। মন্টিকে বাসা থেকে কয়েক দিন বাইরে থাকতে বলে এবং অন্য সবাইকে গা ঢাকা দিতে বলে সাইদুল চলে যায়।

সুমির খণ্ডিত সাত টুকরো লাশ উদ্ধার

গত ১০ মার্চ দুপুর সোয়া ১টায় মতিঝিল থানা পুলিশ কালভার্ট রোডে হোটেল উপবনের উত্তর পাশ থেকে মানুষের একটি হাত ও একটি পায়ের কাটা অংশ উদ্ধার করে। এরপর পুলিশ খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে পাশের ১৬৭/১ এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ লি. ফকিরাপুল ওয়াসা ভবনের পাকা ওয়ালসংলগ্ন মাটি থেকে দুপুর পৌনে ২টায় একটি পা এবং একই ওয়ালসংলগ্ন ৫ গজ পূর্বে ময়লা আবর্জনার ওপর একটি হাত ও শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন একটি বাহু উদ্ধার করে।

আশপাশে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ফকিরাপুল পানির ট্যাংকের ওয়াসা ভবন মডস জোন-৬-এর পূর্ব পাশে ওয়াসা স্টোররুমের টিনের চালায় দুপুর সোয়া ২টায় একটি রক্তমাখা সাদা বিছানার চাদর ও নীল রঙের নাইলনের রশি দিয়ে বাঁধা হাত-পাবিহীন একটি দেহ উদ্ধার করে। এরপর আবার বিকেল সোয়া ৩টায় ১৯৩/১ ফকিরাপুল আহসান মঞ্জিলের সপ্তম তলার সিঁড়ির মাঝখান থেকে মস্তক আগুনে পোড়া, ঝলসানো ও ছাইকালি মাখা অবস্থায় উদ্ধার করে। অঙ্গগুলো একত্র করে একটি নারীসদৃশ দেহের আদল পাওয়া যায়। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অঙ্গগুলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়। ওই দিনই এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।

সুমির খণ্ডিত সাত টুকরো লাশের পরিচয়

গত ১৩ মার্চ বিকেলে ঢামেক হাসপাতালের মর্গে রাখা লাশের টুকরাগুলো দেখে সুমির ভাই মামুন হোসেন পরিচয় শনাক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘লাশ ও বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার বোন সুমির। তার বাবা আব্দুল মান্নান মৃধা রাজশাহীর পবা এলাকার বাসিন্দা। সুমির স্বামী নাসির উদ্দিন এখন কারাগারে।’ নাসির মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানান মামুন। সুমি ২৪৭ ফকিরাপুল গরমপানির গলিতে ভাড়া থাকতেন। তার মতে, লাশের এই বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলো দেখলে পরিবারের লোকজনের কষ্ট হয়তো আরো বেড়ে যাবে। তাই লাশের টুকরাগুলো তিনি না নিয়ে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।

সুমি হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতারকৃতরা

ঘটনার পর গোয়েন্দা পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে জড়িত ছয়জনকে গ্রেফতার করে। তারা হলো মো. সাইদুল ইসলাম (২৭), হানিফ (২৬), রাতুল আহাম্মেদ (২৩), নুরুন্নবী শাওন (১৯), মো. সুজন (২৩) ও মো. সুমন ওরফে তোতলা সুমন (২৪)। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে একটি ছুরি, একটি চাপাতি, কাগজের তৈরি বল (স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো), যা দিয়ে সুমির মুখ বন্ধ করা হয়, একটি কাঠের গুঁড়ি (খাইট্টা) যার ওপরে ভিকটিমের হাত, পা রেখে কাটা হয়, কেরোসিন তেলের বোতল ও আসামিদের পরিহিত রক্তমাখা শার্ট ও প্যান্ট। ঘাতক আটজনের মধ্যে প্রথমে চারজনকে ও পরে আরো দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অপর এক ঘাতক আসামি মোবারক হোসেন মন্টি র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। আলম নামে অপর একজন ঘাতক আসামি এখনো পলাতক।

মতিঝিলে তরুণীর সাত টুকরা লাশ



মন্তব্য চালু নেই