স্তব্ধ করে দেয় সব ইন্দ্রিয়কে

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে যে দুটো বাংলা ছবি রিলিজ করল, সেগুলো কিন্তু যথেষ্ট অর্থবহ। এক নদীর গল্প। নির্বাসিত। স্বাধীনতা দিবসের অনুষঙ্গ দুটি ছবিতেই আছে, দু রকম ভাবে। দুটি ছবির কেন্দ্রেই এক নারী। কিন্তু ভিন্ন তাদের সঙ্কট, ভিন্ন তাদের নারীত্ব। খুবই সঙ্গত দুটো ছবি, যা দর্শককে ভাবতে শেখাবে। নিজেদের অজান্তে, অবচেতনে জেগে থাকবে যে ছবিটি, তার নাম এক নদীর গল্প।

ছবি মুক্তি ইহলোকে নেই পরিচালক সমীর চন্দ। তার আগেই চলে গেছেন কাহিনির স্রষ্টা সুনীল গাঙ্গুলি। দীর্ঘ আট বছর বাদে মুক্তি পেল এই ছবি। আর মুক্তি পাওয়ার পরেই স্তব্ধ হলেন দর্শক। শুধুমাত্র ডিস্ট্রিবিউশনের অভাবই এত বড় মাস্টারপিসকে পরাধীন করে রেখেছিল এতদিন? ভারতীয় ছবির জগত এতদূর এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও। ভাবলে সত্যিই মন খারাপ হয়।

দরিদ্র ব্রাহ্মণ পিতার ভূমিকায় মিঠুন চক্রবর্তী। তাহাদের কথা-র পরে আবার এক জোর ধাক্কা দিলেন ক্রিটিকদের। গায়ে কাঁটা দেওয়া অভিনয়। অপূর্ব অভিব্যক্তি। ধর্ষিতা মৃত মেয়ের নামে নদীর নাম রাখার আপ্রাণ চেষ্টা আর জীবনভর সংগ্রাম করে চলা এক পিতৃহৃদয়। নদীর সঙ্গে কথা বলে চলার দৃশ্য, উন্মাদের মতো গান প্রচার করে চলার দৃশ্যগুলো একবাক্যে অসাধারণ। যে অভিনেতা সবচেয়ে বেশিবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁর আলমারিতে একটি আরও বাড়তেই পারে। না হলেই সেটা আশ্চর্যের হবে।

মিষ্টি মেয়ে শ্বেতার অভিনয় পরিণত। জড়তাহীন, সুঠাম সুন্দর। কয়েকটি দৃশ্য বড় আপন করে, বেশি করে পথের পাঁচালীর কথা মনে পড়ায়। দিদি সাজিয়ে দিচ্ছে ভাইকে। হনুমানের সাজ। সেই অনুষঙ্গই আবার ফিরে আসে একটি সংবেদনশীল মুহূর্তে। দিদির জন্যে ভাইয়ের বেদনা, ক্রন্দন, হাহাকার বড় বড় ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে। নাড়িতে পাওয়া যায় তার স্পন্দন। বহুদিন মনে থাকবে এই দৃশ্যবন্ধ।

ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকায় কৃষ্ণকিশোরের কাছ থেকে পাওয়া গেল সংযত, সংহত অভিনয়। আজকালকার ছবিতে যেটা মিসিং। যিশু সেনগুপ্ত একজন দুঁদে পুলিশ অফিসারের চরিত্রে বেশ অ্যাপিলিং। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম।

আছে সমীর চন্দের সিগনেচার সেট ডিজাইনিং। বাংলার পল্লীগ্রাম তার নিজস্ব স্বাদগন্ধ নিয়ে উপস্থিত। মাটির ঘরের নিখুঁত ডিটেলিং। সূর্যের আলোর ব্যবহারে অপূর্ব সব শট নিয়েছেন। কেলেঘাই নদীর বিস্তৃতির সঙ্গে, প্রবহমানতার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া নারীকণ্ঠস্বর নিয়ে সব মিলিয়ে এক অন্য জগতে নিয়ে চলে যায়।

এক নদীর নাম এমনই একটি ছবি, যার আলাদা করে টেকনিক, ক্যামেরা ওয়র্ক, অভিনয় বা পরিচালনাকে নম্বর দেওয়া যায় না। বিচারের ঊর্ধ্বে গিয়ে এমনই এক প্রশান্তির ধীর স্রোত বইয়ে দেয় দর্শকমনে, যা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে হল ছেড়ে বেরনোর পরেও। বশ করে রাখে সব ইন্দ্রিয়কে। আজ থেকে একশো বছর বাদে যদি আবারও খোঁজ পড়ে এই ছবির রিলের, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

এই অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার জন্য এই ছবির প্রাপ্য পাঁচটি স্টার।



মন্তব্য চালু নেই