‘এরপর আর কোন ভোর আমার জীবনে সকাল নিয়ে আসেনি’

চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু খুন হওয়ার প্রায় আড়াই মাস অতিবাহিত হয়েছে। মাঝের এই সময়ে পরিবারের সদস্যদের চোখের পানি কিছুটা শুকিয়ে গেলেও শুকায়নি হৃদয়ের ক্ষত। তরতাজা প্রাণটি এভাবে ঝড়ে যেতে পারে তা এখনও কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেন না তার আত্মীয়-স্বজন।

সাহসিকতার সঙ্গে চট্টগ্রামে সর্বত্রই জঙ্গি আস্তানা খুঁজে তাদের উত্থান ঠেকানোর নেপথ্যের নায়ক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষা করেছেন। অথচ নিজের স্ত্রীকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে বাঁচাতে না পেরে গুমড়ে কাঁদেন।

শোকে মূহ্যমান পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে হারানোর প্রায় আড়াই মাস পর তাকে নিয়ে নিজের ফেসবুকে এক আবেগী স্ট্যাটাস দিয়েছেন। আওয়ার নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

‘এক সুন্দর দিনে সাধারণ এক কিশোরী বউ হয়ে আমার জীবনে এসেছিল। ঘর-সংসার কী অত বুঝত সে তখন? তাকে বুঝে উঠার সবটুকু সাধ্য হয় নি কখনও। কারণ সদাহাস্য চেহারা যার, তার অন্যান্য অনুভূতি ধরতে পারাটা কঠিন।

তারপর যুগের শুরু। এক কিশোরীর নারী হয়ে উঠার সাক্ষী আমি। ছোট ছোট আবদার আর কথাগুলো ক্রমেই দিক পাল্টালো। হাতের নখের আকার পাল্টে গেল আমার খাবারটুকু স্বাস্থ্যকর রাখার জন্য। ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে মিশে গেল তার চব্বিশঘণ্টা, মাস, বছর এবং যুগ।

রাতের পর রাত কাজ থেকে ফিরে দেখতাম, মেয়েটি ক্রমেই রূপ হারাচ্ছে রাত জেগে আমার অপেক্ষায় থেকে থেকে। হয়ত ভালোবাসার চেয়ে স্নেহই ছিল বেশী। প্রথম সন্তানের জন্মের পর যেন সে স্নেহের ডালপালা ছড়ালো। নিজেকে এত যত্ন পাওয়ার যোগ্য আমার কখনই মনে হয়নি। পোশাক থেকে খাবার, কাজ থেকে ঘুম সবকিছুতেই মায়া। কাজের মাঝে বুদ হয়ে থাকা এই আমির সব পারিবারিক দায়িত্ব সে পালন করতে করতে সবার কাছে আমার নাম মানেই হয়ে উঠে তার অবয়ব। ততদিনে হয়ত সংসার বুঝে গিয়েছে সে। মেয়ে আসলো কোলজুড়ে। দেখতে অবিকল মায়ের মত। সবকিছু জেঁকে ধরে কিশোরীটিকে নারী বানালো। কিন্তু ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়ে তার শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসের সাক্ষী আমি। আমার সামান্যতম ক্ষতির আশংকায় তার কেঁদে অস্থির হওয়ার সাক্ষী আমি। মেয়েটি কী আসলেই সংসার বুঝেছিল ততদিনে? কারণ আমি জানি আমি সংসার তখনও বুঝিনি।

এরপর অনেকগুলো দিন কেটে গেল আমার, আমাদের জীবনে। নেহায়েত সাধারণ কিশোরীটি তখন নারী। ততদিনে সাধারণ মানুষটির ছোয়ায় আমার জীবন অসাধারণ। তখন সে সংসার বোঝে। কিন্তু আমি বুঝিনা, এতেই কী এত ক্ষোভ ছিল তার? এতবেশী ক্ষোভ যে ছেড়েই চলে গেল?

নির্ঝঞ্ঝাট সংসার হয়ত কোন দেবদূতেরও থাকে না। সে জায়গায় আমি তো সংসারই বুঝতাম না। কিন্তু সে সব বুঝতো। আগলে ছিল আমাকে। সে চলে গেল, কিন্তু আমার যাওয়ার উপায় রাখল না। সন্তান দুটো আমার বেচেঁ থাকার বাধ্যবাধকতা। না হয় হয়ত পিছু নিয়ে জানতে চাইতাম, এভাবে যাওয়ার কারণটা। তারপর জীবনের শেষ মৃত্যুতে, না কী মৃত্যুতেই মুক্তি; এই বিশাল বাস্তবতা এসে চাপল আমার ঘাড়ে। শরীর থেকে মাথা কাটা পড়ার অনুভূতি কী এই জীবন মেনে নেওয়ার চেয়েও ভয়ংকর? যার সবটুকু শেষ হয়ে যায় তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার কিছু থাকে না। তবুও আমার কাছ থেকে আরও কী যেন চান স্রষ্টা ও সৃষ্টি! তারাই সব বলেন!

গোলকধাঁধার মারপ্যাঁচ বুঝার বয়স কী হয়েছে মায়ের মৃত্যুর সাক্ষী ছেলেটার? তার প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর দেওয়ার মত শব্দ দুষ্প্রাপ্য। যখন মা হারানো মেয়েটার অযথা গড়াগড়ি দিয়ে কান্নার শব্দ কেবল আমিই শুনি, তখন অনেকেই নতুন নতুন গল্প বানাতে ব্যস্ত। আমি তো বর্ম পড়ে নেই, কিন্তু কোলে আছে মা হারা দুই শিশু। আঘাত সইতেও পারি না, রুখতেও পারি না।

এরপর আর কোন ভোর আমার জীবনে সকাল নিয়ে আসেনি। সন্তান দুটো এবং আমি আর স্নেহের ছায়ায় ঘুমাইনি।এরপরই আমি বুঝেছি সংসার কী।

সংসার মানে তুমি।’

গত ৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় চট্টগ্রামের জিইসি এলাকায় গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন এসপি বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু।

হত্যাকাণ্ডের পর তার স্বামী বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন। এ হত্যাকাণ্ডের ২০ দিনের মাথায় মামলায় আটক তিন সন্দেহভাজন ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করতে বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কী তথ্য, তা পুলিশ স্পষ্ট করেনি।

স্ত্রী খুন হওয়ার পর থেকে দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ভুঁইয়াপাড়ার শ্বশুরবাড়িতেই আছেন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। বাবা আবদুল ওয়াদুদ মিয়াও পুলিশে চাকরি করেছেন।

২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাবুল আক্তারের সঙ্গে মিতুর বিয়ে হয়।

Babul-Akter20160813122230



মন্তব্য চালু নেই