আ.লীগ নেতার ছেলে নিহত রোহান

‘স্বপ্নেও ভাবিনি শেষ পর্যন্ত ছেলেকে এভাবে পাব’

রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর হত্যাযজ্ঞে অংশ নেওয়া সন্ত্রাসীদের একজন রোহান ইমতিয়াজ। হামলার পরদিন যে পাঁচ হামলাকারীর ছবি সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ আইএসের বরাতে প্রকাশ করে, সেখানে ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোহান।

সাইট ইন্টালিজেন্স গুলশানের হামলাকারীদের ছবি প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হত্যাকারীদের অনেকেরই পরিচয় উঠে আসে। সেখান থেকেই জানা যায়, রোহান ইমতিয়াজ আওয়ামী নেতা ইমতিয়াজ খান বাবুলের ছেলে। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ছিলেন।

সাইটে রোহান ইমতিয়াজের ছবির প্রকাশের সঙ্গে ফেসবুকে বেরিয়েও আসে তাঁর পারিবারিক তথ্য। ইমতিয়াজ খান বাবুল নিজেও ছেলের সঙ্গে তাঁর ছবি প্রকাশ করেছিলেন এ বছরের ২১ জুন। যেখানে তিনি গত বছরের একই দিনে পোস্ট করা এক ছবি প্রকাশ করে লেখেন, ‘বাবা কোথায় তুমি, প্লিজ ফিরে এসো।’

ইমতিয়াজ খান বাবুলের ফেসবুকে থাকা নির্বাচনী লিফলেটের তথ্য অনুযায়ী তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এবং সাইক্লিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক।

রোহানের মা স্কলাসটিকা স্কুলের একজন শিক্ষিকা, মা-বাবার একমাত্র ছেলে সন্তান রোহানের দুই বোন আছে। তাঁরা মোহাম্মদপুরে বসবাস করেন বলে পরিবার জানায়।

গত শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় একদল অস্ত্রধারী ঢুকে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর শনিবার সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে রেস্তোরাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয় নিরাপত্তা বাহিনী। এ ঘটনায় নয়জন ইতালিয়ান, সাতজন জাপানি, তিনজন বাংলাদেশি এবং একজন ভারতীয় নাগরিক নিহত হন। এ ছাড়া দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ পাঁচ হামলাকারীও এই জিম্মি ঘটনায় নিহত হন।

‘স্বপ্নেও ভাবিনি’

রোহানের বাবা ইমতিয়াজ খান বাবুলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য গতকাল রোববারও অনেকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি তা রিসিভ করেননি। তারপর পাঠানো হয় বার্তা। বাবুল বার্তার জবাবে একপর্যায়ে জানান, তিনি অসুস্থ, পরে কথা বলবেন।

সোমবার বিকেলে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এ নেতা।

সাক্ষাৎকারে রোহানের বাবা জানান, এমন ঘটনা যে ঘটবে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। গুলশান হামলার ঘটনার আগে ওই দিন বিকেলেই তাঁর বড় ভাই জাফর খান মারা যান। সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন বিপর্যস্ত। এরই মধ্যে শনিবার রাতে খবর আসে, রোহানের ছবি আইএসের ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে। শুনে হতভম্ব হয়ে বাসায় ছুটে আসেন বাবুল।

এসে দেখতে পান রোহানের খালা, চাচা এবং মামারা বাসায় এসেছেন এবং তাঁর স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

বাবুল বলেন, ‘শনিবার রাতে যখন এদিক-ওদিক থেকে ঘটনাটি শুনি এবং রাত ১১টার দিকে বাসায় ফিরে আমার ছেলের ছবিটি দেখি, তখন আমি আর আমার মধ্যে ছিলাম না। আমার প্রেসারের সমস্যা আছে। আর ওর মা তো ততক্ষণে ফেইন্ট (অজ্ঞান) হয়ে গেছে। ওর মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় ওর খালারা। আমি বাসাতেই ছিলাম।’

‘ছয় মাস আগে হারিয়ে গিয়েছিল রোহান’

ইমতিয়াজ খান বাবুল বলেন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখ। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য আমি তখন কলকাতায় ছিলাম। ওই দিন রাতে আমার মেয়ে ফোন করে জানাল, রোহানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। ওর খালার কাছে ফোন করি, নানার বাসায় ফোন করি। জানতে পারি ও কোথাও যায়নি।

আমার বড় মেয়ের কাছে জানতে পারলাম, ওরা দুই বোন সেদিন খালার বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিল। রোহান যেতে চায়নি আর বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে এই নিয়ে বড় বোনের সঙ্গে রোহানের কথাকাটাকাটি হয়েছে। ভাবলাম রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে, ফিরে আসবে। আমাদের ফিরে আসার কথা ছিল পরের সপ্তাহে কিন্তু পরদিনও রোহান ফিরে না আসায় আমার স্ত্রী খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এবং স্ত্রীর চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে আমরা ১ জানুয়ারি দ্রুত ফিরে আসি।

ফিরে আসার পর রোহানের বিভিন্ন বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের বাসায় খোঁজ করার চেষ্টা করেন রোহানের বাবা-মা। কিন্তু কেউই জানাতে পারছিলেন না রোহানের খবর। নিজ বাসার দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটির ব্যাগ নিয়ে সাধারণভাবেই বের হয়ে যান রোহান।

এরপর ৩ তারিখে পুলিশের সঙ্গে ছেলের নিখোঁজের বিষয়ে যোগাযোগ করেন রোহানের বাবা। তিনি বলেন, ‘পুলিশকে ছেলের ফোন নাম্বার, পাসপোর্টের কপিসহ নানা তথ্য দেই। এর পরের দিন আমরা মোহাম্মদপুর থানায় এ বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। জিডি করার পর ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশ্বাস দিয়েছিলেন, অচিরেই রোহানকে খুঁজে বের করা হবে।’

বাবুল জানান, এর পর থেকে তিনি প্রায়ই থানায় যেতেন। এ সময়ই তাঁর মনে হলো, রোহানের ব্যাগে তো ওর পাসপোর্টটা আছে। সে যদি বাইরে কোথাও চলে যায়। সে যদি পাসপোর্ট ব্যবহার করতে চায়, তাই পুলিশকে পাসপোর্টের বিষয়ে জানিয়ে রাখা হয়। এর পর থেকে থানায় গিয়ে বসে থাকতেন, যদি ছেলের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়।

রোহানের বাবা বলেন, ‘ওর পাসপোর্ট ছিল কিন্তু তাতে কোনো দেশেরই ভিসা করা ছিল না। ওই পাসপোর্ট তার কাছেই ছিল। কিন্তু ওই পাসপোর্ট নিয়ে সে যাতে দেশের বাইরে যেতে না পারে – ইমিগ্রেশনকে বলে আমি সে ব্যবস্থাও করেছিলাম।’

‘জানতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও’

বাবুল জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে রোহানের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি জানতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর আমি কমপক্ষে চার-পাঁচবার কামাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমার ছেলেকে খুঁজে দেওয়ার জন্য হেল্প চেয়েছি। উনিও পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন।’

বাবুলের দাবি অনুযায়ী, পুলিশের উপকমিশনার শেখ মারুফ হাসান যিনি এই অভিযানে গিয়ে আহত হয়েছেন, উনিও জানতেন রোহানের নিখোঁজের খবর। পুলিশের এ কর্মকর্তা নিজেও বেশ কয়েকবার এ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। তাঁকে প্রায়ই ফোন দিতেন রোহানের বাবা।

‘মেধাবী ছিল রোহান’

সাক্ষাৎকারে রোহানের বাবা বলেন, “আমার ছেলে খুব মেধাবী ছিল। স্কলাসটিকায় ‘ও লেভেল’ এবং ‘এ লেভেলে’ সব সাবজেক্টে ‘এ’ পেয়েছিল। এ লেভেলে রোহান অঙ্কে ৯৮ নম্বর পেয়েছিল যা ছিল সেই বছর বাংলাদেশের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর। এ লেভেল পাসের পর ও ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ এবং নর্থ সাউথে চান্স পায়। পাবে না কেন, ওর রেজাল্ট তেমনই ছিল।”

বাবুল বলেন, ‘রোহানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে নর্থসাউথে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার একটা খবর শোনা যাচ্ছিল। এই জঙ্গি-ফঙ্গি, ব্রেইন ওয়াশ এসবের ভয়ে আমি আর ওর মা ওকে নর্থ সাউথে ভর্তি করালাম না। আর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে রাজনীতির ঝামেলা এসব কারণে ওর মা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির বিষয়ে খুব আপত্তি জানাল। ওকে ভর্তি করলাম ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। ওখানেই পড়ত রোহান। প্রথম সেমিস্টারে সে ওর ডিপার্টমেন্টে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল। ও নিয়মিত পড়াশোনা করত। আর আমরা বিষয়টি নিয়ে খুশি ছিলাম।’

নানার কাছে নামাজের শিক্ষা

রোহানের বাবা জানান, নিয়মিত নামাজ পড়ত সে। তিনি বলেন, ‘ওর নানা ছিলেন নামাজি মানুষ। রোহান যখন ক্লাস ফাইভে, তখন ওর নানা একবার আমাদের বাসায় এসে তিন মাস ছিলেন, ওই সময়ে রোহানকে তিনি মসজিদে নিয়ে যেতেন। আমাদের বাসা থেকে মসজিদ ২০ কদমের হাঁটাপথ। রোহানের নানা তখন অসুস্থ ছিলেন, তবুও রোহানকে নিয়ে মসজিদে যেতেন। রোহানের মধ্যে এই প্রাকটিসটি রয়ে গিয়েছিল, সে নিয়মিত নামাজ পড়ত। এমনিতে আমাদের বাসার কেউ ওইভাবে নিয়মিত নামাজ পড়ে না, কিন্তু রোহান পড়ত আর এ নিয়ে ওর মাও খুশি ছিল।’

ছেলে সম্পর্কে বাবুল আরো বলেন, ‘রোহান শান্ত ছেলে ছিল। ও কখনোই কারো সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করেছে বলে শুনি নাই। বাসায় ভাইবোনদের মধ্যে একটু আধটু- সেটা সবারই হয়। কিন্তু বাইরে কারো সঙ্গে তর্ক করেছে এমন অথবা আমার সঙ্গেও তর্ক করে নাই। বাসার বাইরেও সে থাকত না। ওর খালাতো ভাই ছিল, ওর সঙ্গে পড়ত। তার সঙ্গে খালার বাসায় থাকত। এ ছাড়া রাতে বাইরে কোনোদিন থাকতে দেখিনি।’

অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর

বাবুলের জবানিতে, ‘রোহান হারিয়ে যাওয়ার পর আমি বারবার আমার ফেসবুকে আমার সঙ্গে, ওর মায়ের সঙ্গে, ওর বোনদের সঙ্গে পরিবারের সঙ্গে তোলা ওর ছবিগুলো ফেসবুকে নিয়মিত পোস্ট করতাম। আর লিখতাম-‘বাবা কাম ব্যাক।’ আমার ধারণা ছিল, ও হয়তো রাগ করে কোথাও আছে। হয়তো কোথাও চাকরি-টাকরি করছে অথবা বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে আছে। কিন্তু ছেলেকে যে এভাবে পাব এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।’

বাবুল বলেন, ‘স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার সংসার। স্ত্রী স্কলাসটিকার শিক্ষক। বড় মেয়ে চিকিৎসক, ও খুব ভালো ছাত্রী ছিল। এরপর রোহান আর ছোট মেয়ে। ছোট মেয়েও এখন স্কলাসটিকায় পড়ে।’

রোহানের বাবা আরো জানান, ‘আমার ছেলেটা হারিয়ে যাওয়ার পরে আমার বড় ভাইও খুব হতাশ হয়েছিলেন। ভেঙে পড়েছিলেন। গুলশানের ঘটনার দিন বিকেলে আমার বড় ভাইও আমাদের ছেড়ে চলে যান। (সোমবার) তাঁর কুলখানি চলছে।’

হারিয়ে গেছে এমন অনেক রোহান

আওয়ামী লীগের নেতা ইমতিয়াজ খান বাবুল বলেন, ‘রোহানকে খুঁজতে গিয়ে থানায় ঘুরে ঘুরে আমি দেখেছি রোহানের মতো এমন স্টাবলিশ ফ্যামিলির অনেক ছেলে হারিয়ে গেছে। সানিডেল, স্কলাসটিকা, নর্থ-সাউথ, ব্র্যাক এমন অনেক বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষিত পরিবারের ছেলে মিসিং। পুলিশ জানে এদের কথা। অনেক বড় সরকারি কর্মচারী, শিল্পপতির সন্তানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘সন্তানহারা এসব বাবা-মায়ের মতো আমিও এতদিন ভাবতাম ছেলে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। ফিরে আসবে। কিন্তু এখন বুঝেছি ওরা ফাঁদে পড়েছিল।’

লাশ পুলিশের কাছে

সাক্ষাৎকারে ইমতিয়াজ খান বাবুল দাবি করেন, ‘(রোববার) পুলিশের পক্ষ থেকে আমার পরিবারকে জানানো হয়েছে, আমার ছেলে রোহানের মৃতদেহ তাদের কাছে আছে। প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষে মৃতদেহ দেওয়া হবে।’

পুলিশের প্রকাশ করা ছবির মধ্যে তো রোহান নেই। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে, বাবুল বলেন, ‘এই প্রশ্নটি পুলিশকে আমার ছোট ভাইও করেছিল। পুলিশ জানিয়েছে ওর ফেস নেই। তাই ছবি দেওয়া হয়নি।’ -এনটিভি



মন্তব্য চালু নেই